রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের রফতানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ (আইসিসিবি গতকাল সংগঠনের প্রকাশিত ত্রৈমাসিক বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে এমন উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে।

সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনা মহামারী দ্বারা বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে ও পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব এখন সবচেয়ে খারাপ মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। এ যুদ্ধ একটি বড় মানবিক সংকট, যার দ্বারা কয়েক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা বিশ্বের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি গুরুতর আঘাত।

আইসিসিবি উল্লেখ করে, উন্নত দেশগুলো কয়েক দশকের মধ্যে রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে দেশগুলো, যা ভোক্তার চাহিদা কমিয়ে দেবে। এ ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়, কারণ বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রফতানি গন্তব্য এসব দেশ। বাংলাদেশ এরই মধ্যে যুদ্ধের প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। রাশিয়া ও ইউক্রেনে রফতানি হ্রাসের পাশাপাশি প্রধানত তেল ও খাদ্যের জন্য আমদানি বিল বেড়ে যাওয়ায় এটা হয়েছে।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের পর তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম দ্রুত বেড়েছে। এটি চলতি বছর আরো বাড়তে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। জ্বালানি সরবরাহের সংকট বিশ্বকে ১৯৭০-এর তেল সংকটের কথা মনে করিয়ে দেয়, যা বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধিকে স্থবির করে দিয়েছিল ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির মধ্যেও।

সম্পাদকীয়তে আইসিসিবি জানায়, ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো তার বেঞ্চমার্ক সুদহার দশমিক ৭৫ শতাংশে বাড়িয়েছে। যেহেতু বাজারের ওপর প্রভাব যাই হোক না কেন মুদ্রাস্ফীতিকে আরো জোরদারভাবে মোকাবেলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটলমেন্ট (বিআইএস), কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে বিবেচিত, তার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ করেছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে বৈশ্বিক অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে অবশ্যই দ্রুত এবং সিদ্ধান্তমূলক কাজ করতে হবে মুদ্রাস্ফীতি গেঁথে বসার আগেই। এমন অবস্থায় দেশগুলো তাদের তাত্ক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগের বিষয় বিবেচনায় রেখে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পশ্চিমের জন্য, এটি প্রধানত একটি নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং শক্তি এবং খাদ্য সরবরাহের বিকল্প খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা ছাড়াও তারা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু বাকি বিশ্বের জন্য, মানবিক দুর্ভোগ এবং অর্থনৈতিক উদ্বেগ প্রথমেই আসে কারণ যুদ্ধ সমগ্র সরবরাহ শৃঙ্খলকে ব্যাহত করেছে, উৎপাদন, ব্যবসা এবং জীবনকে অস্থির করে তুলেছে।

যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে আইসিসিবি সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করে, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি) তথ্যানুসারে প্রায় ২৭ কোটি ৬০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়েছে। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) অনুমান অনুযায়ী যুদ্ধের প্রভাবে আরো ১ কোটি ১০ লাখ-১ কোটি ৯০ লাখ ক্ষুধার্ত মানুষ নতুন যোগ হতে পারে।


এ অবস্থায় ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক ঘোষণা করেছেন যে শরণার্থীদের জন্য খাদ্য রেশন অর্ধেকের মতো কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, কারণ ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং তহবিল সীমাবদ্ধতার কারণে ক্ষুধার্ত মানুষের সংকট বেড়ে গিয়েছে।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটস অনুসারে, ইউক্রেন বিশ্বের বৃহত্তম সূর্যমুখী তেলের উৎপাদক, রাশিয়া রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। বিশ্বে মোট উৎপাদনের ৬০ শতাংশ এ দুই দেশে হয়। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী ৪০ কোটি মানুষকে খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন করে ইউক্রেন, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাপী শস্য সরবরাহের ১০ শতাংশ এবং বিশ্বব্যাপী ভুট্টা সরবরাহের ১৩ শতাংশ।

এফএওর মতে, সারের মতো খামারের ইনপুটগুলোর বর্ধিত খরচ কৃষকদের উৎপাদন সম্প্রসারণ থেকে বিরত রাখতে পারে ও রেকর্ড আমদানি বিলের সম্মুখীন দরিদ্র দেশগুলোয় খাদ্যনিরাপত্তা আরো খারাপ করতে পারে। ফলস্বরূপ সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং এশিয়ার কিছু দেশ, যেমন বাংলাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়ায়ও এর প্রভাব পড়তে পারে।

সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে, মানবতার দুর্ভোগ, লাখ লাখ জীবন এবং ক্রমাগত বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতার জন্য বৈশ্বিক আধিপত্যের লড়াই ত্যাগ করার জন্য পরাশক্তিদের প্রতি আহ্বান জানায় ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স এবং ১০০টিরও বেশি দেশে এর ৪ কোটি ৫০ লাখ সদস্য।

সূত্র- বণিক বার্তা অনলাইন