দেশের জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর গাজীপুর এবং সবচেয়ে কম দূষিত শহর সিলেট। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত বায়ু দূষণ বিষয়ক 'এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩'-এ এসব তথ্য উঠে এসেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) আয়োজিত 'বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়' শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান সংগঠনটির যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, গাজীপুরের বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা, যার ব্যাস সাধারণত ২.৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোট (পিএম ২.৫)- এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৮৯.৮ মাইক্রোগ্রামে পৌঁছেছে। এ মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের (৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে ১৮ গুণ এবং নির্ধারিত (বার্ষিক) মান মাত্রার (প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে ৬ গুণ বেশি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কম দূষিত জেলা শহর হলো সিলেট। শহরটিতে প্রতি ঘনমিটারে ৪৮.৫ মাইক্রোগ্রাম বস্তুকণা পাওয়া গেছে এবং এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে ৯.৭ গুণ বেশি ও বাংলাদেশের নির্ধারিত জাতীয় আদর্শ (বার্ষিক) মানমাত্রার চেয়ে ৩.২৩ গুণ বেশি।

তিনি জানান, গাজীপুর ছাড়াও নোয়াখালীতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮.৭ মাইক্রোগ্রাম, কুমিল্লাতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮.২ মাইক্রোগ্রাম, চাঁদপুরে প্রতি ঘনমিটারে ৮৭.৮ মাইক্রোগ্রাম, ঢাকায় প্রতি ঘনমিটারে ৮৭.২ মাইক্রোগ্রাম, নারায়ণগঞ্জে প্রতি ঘনমিটারে ৮৬.৯ মাইক্রোগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতি ঘনমিটারে ৮৩.১ মাইক্রোগ্রাম, কিশোরগঞ্জে প্রতি ঘনমিটারে ৮২ মাইক্রোগ্রাম এবং টাঙ্গাইলে প্রতি ঘনমিটারে ৮১ মাইক্রোগ্রাম অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি পাওয়া যায়।

বাপার যুগ্ম সম্পাদক জানান, বায়ু দূষণের কারণগুলোর মধ্যে আছে প্রাকৃতিক ও আবহাওয়াজনিত কারণ, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব।  স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণা থেকে পাওয়া যায় যে, রাস্তা খোঁড়াখুড়ি ও নির্মাণ কাজ থেকে ৩০ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্প কারখানা থেকে ২৯ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, আন্তঃদেশীয় বায়ু দূষণ থেকে ৬.৫ শতাংশ, গৃহস্থালি বা রান্নার চুলার কাজ থেকে ৮.৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ু দূষণ ঘটে।

আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু ২ বছর ৪ মাস কমছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস। এছাড়া ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিটালে ২০২১ সালে আউটডোর এবং জরুরি বিভাগ মিলিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। ৭ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৫ হাজার। অন্যদিকে রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলিয়ে রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। এবারের (২০২৩) জুলাইয়ে সে সংখ্যা ১৪ হাজার পার হয়েছে। আয়ুষ্কালের পরিপ্রেক্ষিতে বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা, দূষণ বাংলাদেশে মানব স্বাস্থ্যের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি বলে জানিয়েছে কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স- ২০২৩।

আরও পড়ুন

চার বছরে ভারতে ইলিশ রপ্তানি ৫৫৪১ টন

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সীসা দূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে ১ লাখ ৩৮ হাজারও বেশি মানুষ এবং এ কারণে শিশুদের আইকিউ কমে যাচ্ছে এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

বাপা'র পক্ষ থেকে বায়ুমান উন্নয়নে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়।

স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ:

১. নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখতে হবে ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নিতে হবে।

২. শুষ্ক মৌসুমে সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে দূষিত শহরগুলোতে প্রতি ২-৩ ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪. অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে।

৫. ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেস বিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।

মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ

৬. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদ বাগান করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে, দূষিত শহরগুলোর আশপাশে জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।

৭. আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৮. আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে সেন্ড ব্লকের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।

৯. সিটি গভর্নেন্সের প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্বল্পসময়ে সম্পন্ন করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ

১০. নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে।

আরও পড়ুন

পদ্মা সেতুতে চলবে যেসব ট্রেন,ট্রেনের ভাড়া, কোন পথে কত

১১. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষণ স্টেশনের (ক্যামস) ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এছাড়াও বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে।

১২. পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করতে হবে।

১৩. সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ু দূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য নির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ু দূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন বাপার সভাপতি নুর মোহাম্মদ তালুকদার, সহ সভাপতি অধ্যাপক এম শহীদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর, সহ সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব ।

সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড