একজন শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি যদিও হতাশাজনক হতে পারে, তবে এটি সাধারণ এবং সাধারণত স্বল্পকালীন

আপনি মাঝে মাঝে এমনটি লক্ষ করে থাকবেন যে, আপনার সন্তান খুব দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে (যেমন সে টয়লেট ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করেছে), আবার আকস্মিকভাবেই এক ধাপ পিছিয়ে আসতে পারে (হয়তো টয়লেট ব্যবহার করতে শিশু অস্বীকৃতি জানাচ্ছে)। এক্ষেত্রে মনে রাখবেন, আপনি একা এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি নন। বেড়ে উঠছে এমন শিশুদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, পশ্চাৎপদতা একবারে সাধারণ বিষয়। শিশুরা কী কারণে হঠাৎ পিছিয়ে পড়ে এবং এক্ষেত্রে আপনি কীভাবে আপনার সন্তানকে সহায়তা করতে পারেন - সে সম্পর্কে আমরা স্কুল অফ ইয়েল মেডিসিনের শিশু অধ্যয়ন কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক এবং শৈশবকালীন শিক্ষার ইয়েল কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক, ন্যান্সি ক্লোজ, পিএইচডি-এর সাথে কথা বলেছি।



পশ্চাৎপদতা কী? এর কারণ কী?
ক্লোজ বলেন, “শিশুর বিকাশের ধারণার সাথে আমি তার পশ্চাৎপদতার বিষয়টিকে যুক্ত করতে চাই। নিজেদের বিকাশের সময় বেশিরভাগ শিশুরই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার খুব শক্তিশালী তাগিদ থাকে। বিভিন্ন বিষয় অনুসন্ধান করা, পরিচালনা করা ও জয় করার ক্ষেত্রে শিশুদের একটি প্রাকৃতিক শক্তি রয়েছে।”
তবে, নতুন কোনও জিনিস করতে পারার উত্তেজনার সাথে মানসিক চাপও আসে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, হাঁটতে শিখছে এমন এক শিশু তার নতুন দক্ষতা অর্জন করার জন্য আনন্দিত হতে পারে। তবে, মা ও বাবা এখন অনেক দূরে আছে কিংবা সে পড়ে যেতে পারে- এমন ভয় তার মধ্যে কাজ করতে পারে।
বিষয়টিকে ক্লোজ ব্যাখ্যা করে বলেন, “তাই, তার বেড়ে ওঠার সময় যখনই সে হোঁচট খাচ্ছে, সেটা তাকে দমিয়ে দিতে পারে এবং এর ফলে শিশুদের মধ্যে একধরনের পশ্চাৎপদতার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে।”

আরও পড়ুন

শুধু বেগুনে নয়, চাষের মাটিতেই ভারী ধাতু: গবেষণা

পশ্চাৎপদতার আচরণগুলো আসলে কেমন?
পশ্চাৎপদতা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। তবে, সাধারণভাবে, এটা বয়সের চেয়ে অপরিণত প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এসময় আপনার শিশুর মধ্যে খিটখিটে ভাব দেখতে পারেন। ঘুমোতে বা খেতে তাদের সমস্যা হতে পারে বা কথা বলার সময় বয়সের চেয়ে অপরিণত আচরণ করতে পারে ইত্যাদি। নিজেই নিজের পোশাক পরতে পারার মতো দক্ষতা যদি কোনও শিশু অর্জন করে, তখন এসব দক্ষতার অনেকগুলোই হারিয়ে যাচ্ছে এমনটিও আপনি লক্ষ করতে পারেন। ক্লোজ বিষয়টিকে ব্যাখা করে বলেন, “আপনার সন্তান আগে যা করতো, হঠাৎ করেই সেটা আর নাও করতে পারে।”

পশ্চাৎপদতা কখন ঘটে?
সাধারণত বাচ্চাদের মধ্যে এবং এখনও স্কুল শুরু করেনি এমন শিশুদের মধ্যে আপনি পশ্চাৎপদ আচরণ লক্ষ করতে পাবেন। তবে, বাড়ন্ত শিশু এবং বড় বাচ্চাসহ সকলের মধ্যেই এটি যেকোন বয়সে ঘটতে পারে। একটি শিশুর মধ্যে যদি পশ্চাৎপদতার প্রবণতা থাকে, সেটা সবসময় স্পষ্টভাবে দেখা নাও যেতে পারে। একটি শিশু কিছুটা বেশি ঘ্যান- ঘ্যান করতে পারে, তাকে আরও বেশি খাওয়ানো দরকার হতে পারে, কিছুটা বিরক্তভাব দেখাতে পারে বা স্বাভাবিকের চেয়ে এসময় বেশি কাঁদতে পারে।

পশ্চাৎপদতা কি সাধারণ বিষয়?
পশ্চাৎপদতা যে একটি সাধারণ বিষয় - সে বিষয়ে আশ্বস্ত থাকুন। প্রকৃতপক্ষে, এটিই প্রত্যাশিত এবং পরবর্তী বিকাশের জন্য এটি আসলে খুব সহায়ক। আপনার সন্তানের আরও বেশি দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করার উপায় হিসাবে এটিকে ভাবুন। ক্লোজ বলেন, “আমি এমন কিছু শিশুদের দেখছি যারা দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মূহুর্তে হঠাৎ করেই পিছিয়ে পড়ে। অথবা, তারা দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাওয়ার ঠিক পরপরই আবার পশ্চাৎপদ হয়ে যায়। কী কারণে শিশুদের মধ্যে পশ্চাৎপদতা দেখা দেয় এবং শিশুরা কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে তার ধরণেও ভিন্নতা আছে বলে আমি মনে করি। সাধারণত বাবা-মায়েরা নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের সন্তানদের এগিয়ে যাওয়ার ধরণ এবং এরপর খানিকটা পিছিয়ে পড়া সম্পর্কে জানতে পারেন।” শিশুদের যখন নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয় তখন আকস্মিকভাবে পিছিয়ে পড়া খুবই সাধারণ বিষয়। যেমন, তারা যখন বড় ভাই কিংবা বোন হয়ে যায় বা প্রথমবারের মতো প্রি-স্কুলে যায়, এরকম সময়ে পশ্চাৎপদতা খুবই সাধারণ।

আরও পড়ুন

যেভাবে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা

পশ্চাৎপদতার সময়ে বাবা-মা কীভাবে তাদের সন্তানদের সহায়তা করতে পারেন?
আপনার সন্তানকে আশ্বস্ত করুন। তাদেরকে বুঝতে দিন যে, তারা নিরাপদ এবং তাদেরকে সহায়তা করার জন্য আপনারা রয়েছেন। আপনি তাদেরকে লজ্জা দিচ্ছেন না, তবুও তারা পিছিয়ে পড়ছে – এ বিষয়টি তাদেরকে উপলব্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করুন। নিচের বিষয়গুলো লক্ষ করার জন্য ক্লোজ পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “অনেক বড় শিশুরা যা করে তুমি সেটা শেখার চেষ্টা করছো। এটি কিন্তু অনেক কঠিন কাজ। কখনও কখনও আমার কাছ থেকে তোমার সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।”
কঠিন অনুভূতির মধ্য দিয়ে পার হওয়ার জন্য খেলা একটি সহায়ক পদ্ধতি হতে পারে। এক্ষেত্রে ক্লোজ বলেন, “শিশুরা তাদের ভাষা, চিন্তাভাবনা এবং পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে ধারণা বিকাশের পদ্ধতি হিসাবে কল্পনাপ্রসূত খেলা এবং প্রতীকী খেলাকে ব্যবহার করে। সামাজিক ও আবেগগতভাবে, যে বিষয়গুলো প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শিশুরা সমস্যায় পড়ছে এবং তাদের কাছে এগুলো প্রকাশ করার কোনও শব্দ নেই, সেগুলো প্রকাশের জন্য খেলা তাদের একটা উপায় তৈরি করে দেয়।” আপনার সন্তানের খেলার সময় এবং তাদের সাথে আপনি যখন খেলছেন, তখন তাদেরকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আপনার সন্তানের সাথে কী ঘটছে সে সম্পর্কে আপনি অনেক কিছু জানতে পারবেন।
কখনও কখনও আপনার সন্তানের কিছু সময়ের জন্য হলেও চাপ অনুভব করা দরকার। তাদের একদিকে যেমন আশ্বস্ত করা জরুরি, অপরদিকে তাদের প্রত্যাশা থাকা এবং সীমা নির্ধারণ করাও জরুরি। ক্লোজ বলেন, “তারা যে বিশ্বের মালিক নয় - এ বিষয়টি শিশুদের বুঝাও গুরুত্বপূণ! তাদেরকে দূরে ঠেলে দিবেন না। আরও কিছু কঠিন অনুভূতির সাথে খাপ খাওয়ানো এবং বয়সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণের উপায়গুলো খুঁজে পেতে সহায়তা করুন।” তাদের সাথে বসুন, তাদেরকে সাহায্য করুন, শান্ত করুন এবং তারা কী অনুভব করছে সে বিষয়টি অনুধাবন করুন”। উদাহরণ হিসাবে ক্লোজ বলেন, “তোমার বন্ধু তোমাকে খেলনা না দেয়ার কারনে তুমি এত ক্ষিপ্ত হয়েছিলে যে পরবর্তীতে তুমি তাকে ধাক্কা দিয়েছিলে। পরেরবার এমনও হতে পারে যে, খেলনাটি তুমি একবার নিবে এবং তোমার বন্ধু একবার নিবে। এ বিষয়ে শিক্ষক তোমাদের সাহায্য করতে পারেন।”

বাবা-মায়েদের কখন উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?
কিছু কিছু পশ্চাৎপদতা কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে। তবে, এক শিশু থেকে অন্য শিশুর ক্ষেত্রে এর তারতম্যও ঘটতে পারে। সাধারণত, শিশুর মনে কী চলছে তা যদি আপনি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেন এবং শিশুদের সহায়তা করতে পারেন, তাহলে এর মাধ্যমে তারা সমাধান খুঁজে পেতে সক্ষম হবে। যতদিন এধরণের পশ্চাৎপদতা স্থায়ী হওয়ার কথা, তার চেয়ে দুই বা তিন সপ্তাহ বেশি দীর্ঘস্থায়ী হলে, সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন ক্লোজ। ক্লোজ বলেছেন, “নিজেদের বিকাশ এগিয়ে নেয়ার জন্য শিশুরা খুব ব্যাকুল থাকে। কিন্তু যদি সেই ব্যাকুলতা না থাকে তবেই আমি উদ্বিগ্ন হব। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যদি এটি বিকাশকালীন স্বাভাবিক পশ্চাৎপদতা হয়, তবে এটা ক্ষণস্থায়ী হবে বলেই আমার ধারণা।”

আরও পড়ুন

৮০০ কোটির বিশ্বে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা
________________________________________
ন্যান্সি ক্লোজ, পিএইচডি, ইয়েল শিশু অধ্যয়ন কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক। তিনি শৈশবকালীন শিক্ষার ইয়েল কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক। এছাড়াও তিনি মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক এবং এমওএমএস অংশীদারিত্ব ও ইয়েল বাবা-মা এবং পরিবার বিকাশ কর্মসূচির ক্লিনিকাল পরিচালক। তিনি দুই সন্তানের জননী এবং দুজনের পিতামহী।
ম্যান্ডি রিচ-এর সাক্ষাৎকার এবং নিবন্ধ, ডিজিটাল কনটেন্ট লেখক, ইউনিসেফ।