Spoken+Grammar Bundle

আট বছরের ছোট্ট ছেলে। বেড়ে ওঠা এমন এক শহরে; যেখানে মাদক চোরাচালান, গুম-খুন নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। বাড়ি থেকে কয়েক গজ এগোলেই বড় বড় মাদক কারবারির আখড়া। বেশিরভাগ সময়ই মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে দরজায় পুলিশের কড়া নাড়ার শব্দে। এমন এক পরিবেশ, যেখানে চারপাশজুড়ে শুধুই হতাশা। এ রকম পরিস্থিতিতে ছোট্ট সেই বালকের মনে শুধু ফুটবলই আশার সঞ্চার করত।

ফুটবল পায়ে নিলেই সব হতাশা যেন হারিয়ে যেত তাঁর। নিজেকে মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী আর সাহসী কেউ। কী ভাবছেন, কোনো এক রুপালি পর্দার গল্প?-না। এটি ব্রাজিলিয়ান রাইট উইঙ্গার অ্যান্থোনি সান্তোসের বেড়ে ওঠার গল্প।

‘দ্য পেল্গয়ার্স ট্রিবিউন’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের বেড়ে ওঠার গল্প শুনিয়েছেন ২২ বছর বয়সী এই ব্রাজিলিয়ান। অ্যান্থোনি বলেন, "আমি নরকে জন্মেছিলাম। না, আমি মজা করছি না। আমার জন্ম সাও পাওলোর ‘ফাভেলা’ নামক শহরে। ‘ফাভেলা’কে কে সবাই ‘ছোট নরক’ বলে ডাকত। আমাদের বাসা থেকে মাত্র ১৫ মিনিট দূরত্বেই ছিল মাদকের আখড়া। সেখানে সব সময়ই মাদকের বেচাকেনা চলত। এমনকি আমাদের জানালা দিয়ে সব সময়ই বাতাসের সঙ্গে মাদকের গন্ধ ভেসে আসত। বন্দুক, গোলাগুলি- এসব একটা সময় আর আমাদের জন্য আতঙ্কের বিষয় ছিল না। এগুলোর সঙ্গে 'ফাভেলা'র মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।"

নিজের কৈশোরের গল্প শোনানোর সময় ছোট্টবেলার সেই ভয়ংকর দিনগুলো যেন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলেন অ্যান্থোনি। নিজের জীবনে প্রথম মরদেহ দেখার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমার বয়স তখন ৮ বা ৯। আমি সকাল বেলা স্কুলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি রাস্তায় একজন লোক পড়ে আছে। সে নড়ছিল না। তার সাহায্য প্রয়োজন কিনা, দেখার জন্য আমি সামনে এগিয়ে যাই। আর তখনই বুঝতে পারি সে আসলে মারা গেছে। এর পর আমি চোখ বন্ধ করে সেই মৃতদেহ পেরিয়ে স্কুলে যাই। ভাববেন না, আমি কিছু বাড়িয়ে বলছি। ফাভেলায় এগুলো ছিল খুবই নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা।‘

এই ভয়ংকর পরিবেশ থেকে অ্যান্থোনির মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপলক্ষ ছিল ফুটবল। তবে ফুটবল খেলার জার্নিটা মোটেও সহজ কিছু ছিল না। দরিদ্র পরিবারের পক্ষে অ্যান্থোনিকে বুট কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। 'আমার জন্য সেখানে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পেশা ছিল- হয় কোনো ড্রাগ ডিলার হওয়া; না হয় বাসের ড্রাইভার অথবা চোর। তবে আমি ঠিক করেছিলাম, যত যাই হয়ে যাক, আমি মাথা নত করব না। আমি শুধু ফুটবলেই নিজেকে খুঁজে পেতাম। আমি সে সময় খালি পায়েই খেলতাম। বুট কেনার মতো সামর্থ্য আমার ছিল না।’

তবে পরবর্তী সময়ে অ্যান্থোনির উত্থানের গল্প রীতিমতো রূপকথাকেও হার মানায়। ১০ বছর বয়সে সাও পাওলোর ক্লাবে যোগ দেন অ্যান্থোনি। ২০১৯ সালে পাওলিস্তার ফাইনালে সাও পাওলোর হয়ে গোল করেন এই উইঙ্গার। অসাধারণ ড্রিবলিং স্কিল আর গতির কারণেই সবার নজরে আসেন অ্যান্থোনি। এর পরই এই ব্রাজিলিয়ানকে দলে ভেড়ায় ডাচ ক্লাব আয়াক্স। আয়াক্সের হয়ে অসাধারণ দুটি মৌসুম কাটিয়ে, এই মৌসুমেই ৮৬ মিলিয়ন ইউরোতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছেন অ্যান্থোনি। ব্রাজিলের ২৬ সদস্যের কাতার বিশ্বকাপের চূড়ান্ত স্কোয়াডেও রয়েছেন এই ম্যানইউ রাইট উইঙ্গার।

ছোটবেলায় 'ফাভেলা'র সেই কঠিন দিনগুলোতে অ্যান্থোনি মাকে বলতেন, 'দেখো মা, আমাদেরও একটা রেঞ্জ রোভার থাকবে।' স্বপ্নবাজ ছেলের কথা শুনে মা মুচকি হাসতেন। আয়াক্সের হয়ে খেলার সময় সত্যিই লাল রঙের একটি রেঞ্জ রোভার কিনে ফেলেন অ্যান্থোনি। অনেকেই অ্যান্থোনিকে জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে এত দ্রুত সময়ে তিনি নিজের ভাগ্যের চাকা বদলে ফেললেন? এর উত্তর নিজেই দিয়েছেন ২২ বছর বয়সী এই ব্রাজিলিয়ান। 'আমি ফুটবল মাঠে সব সময়ই নির্ভার থাকি। আমার কখনোই ভয় কাজ করে না। যে ছোটবেলায় লাশ ডিঙিয়ে স্কুলে যেত, সে আর কী ভয় পাবে।’ অ্যান্থোনি সান্তোসের মতো জীবনযুদ্ধের সংগ্রামী সৈনিকরাই বোধ হয় ফুটবল খেলাটির প্রকৃত সৌন্দর্য।

আরও পড়ুন

বিশ্বকাপের ৮ ম্যাচের ভেন্যুর প্রকৌশলী ছিলেন বাংলাদেশের ওয়াশিকুর

মালানের সেঞ্চুরি ম্লান করে অস্ট্রেলিয়ার জয়

যে যাই বলুক নেইমারই সেরা: রিচার্লিসন