শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বার্ষিক ১০ হাজার কোটি টাকা বা তার বেশি আয় করা কোম্পানিগুলোর তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) লিমিটেড। সরকারের চলমান ও বাস্তবায়ন হয়ে যাওয়া মেগা প্রকল্পগুলোর সুবাদে এ আয় করেছে বিএসআরএম।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৯২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চতুর্থ কোম্পানি হিসেবে এ মাইলফলক অর্জন করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে এই মাইলফলক অর্জনকারী অপর তিনটি কোম্পানি হলো তিতাস গ্যাস, গ্রামীণফোন ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড (বিএটিবিসি)।

বিএসআরএমের আর্থিক বিবৃতি অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় হয়েছে ১১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহে বিঘ্ন এবং কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির মতো কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও কোম্পানিটি আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪৪ শতাংশ বেশি আয় করেছে। 

বিএসআরএম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমের আলীহোসাইন গতকাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন  'বিগত বছরগুলোতে সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো থেকে আমাদের আয়ের একটা বড় অংশ এসেছে। কিন্তু গত বছর থেকে সরকারি প্রকল্পগুলো ধীরগতিতে চলছে। তবে বেসরকারি খাতের চাহিদা বেড়েছে, যা আমাদের ব্যবসা বাড়াতে সাহায্য করেছে।'

কোম্পানিটি জানিয়েছে, ছয় দশকের যাত্রায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে তারা সর্বোচ্চ আয় করেছে। যদিও এ অর্থবছরে কোম্পানিটির মুনাফা আগের বছরের ৩০৮ কোটি টাকা থেকে কমে ২৯১ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

আরও পড়ুন

যে কারণে হু হু করে বাড়ছে খেলাপি ঋণ

বিএসআরএম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমের আলীহোসাইন টিবিএসকে বলেন, 'মূল্যস্ফীতি আমাদের ওপর পণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য চাপ তৈরি করেছে, যার সুবাদের আমাদের রেকর্ড আয় হয়েছে। এছাড়া আন্তঃকোম্পানি বিক্রি আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে।' তিনি আরও বলেন, রড ও বিলেট বিক্রির পরিমাণ আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।

আমের আলীহোসাইন বলেন, ডলার সংকট, এলসি খুলতে সমস্যা এবং সময়মতো কাঁচামালের সরবরাহ না পাওয়ায় তারা ঝামেলায় পড়েছেন। 'এসব কারণে উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে। আমরা এখনও সংকটমুক্ত নই। এই সমস্যার মধ্যেই আমরা প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার চেষ্টা করছি,' বলেন তিনি।

মেগা প্রকল্পগুলোতে উচ্চ গ্রেডের ইস্পার সরবরাহ

দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি পদ্মা সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে উচ্চ গ্রেডের রড সরবরাহ করেছে।

কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যখন কোনো গ্রেডেড ইস্পাত ছিল না, ওই সময় বিএসআরএম লিমিটেড তাদের পণ্য নিয়ে এসেছিল বাজারে। বিএসআরএমই দেশের প্রথম ইস্পাত ব্র্যান্ড হিসেবে যুক্তরাজ্যে ৫ মিলিয়ন সাইক্লিক লোডিং ফ্যাটিগ টেস্টে উত্তীর্ণ হয়। 

এই খাতে প্রবল প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে বিএসআরএমের আয় ১৫৯ শতাংশ বেড়েছে।

তালিকাভুক্ত অপর যে তিন প্রতিষ্ঠানের আয় ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে সেগুলোর মধ্যে বিএটিবিসি ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার কোটি টাকা, তিতাস গ্যাস ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং গ্রামীণফোন ২০২২ সালে ১৫ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে।

গত অর্থবছরে এমএস রডের দাম আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৫–১৭ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরে ইস্পাত কোম্পানিগুলো প্রতি টন রড ৯০ হাজার থেকে ৯৪ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে, যা এক বছর আগে ছিল ৮০ হাজার টাকা। 

তবে রেকর্ড আয় করেও মুনাফায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি বিএসআরএম লিমিটেড। ব্যবসার খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে মুনাফা কমে গেছে কোম্পানিটির।

ওই অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ২৯১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫.৫১ শতাংশ কম।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে (৮৮ শতাংশ বেড়েছে)। বড় শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম ১১.৯৮ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে (১৫০ শতাংশ বেড়েছে)।

কোম্পানিটি অর্থবছর শুরু করে লোকসান দিয়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) বিএসআরএম ১৬৮ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এরপর লোকসান কাটিয়ে উঠে বাকি প্রান্তিকে লাভের ধারায় ফেরে কোম্পানিটি।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) তথ্যানুসারে, বর্তমানে দেশে বছরে ৭০–৭৫ লাখ টন এমএস রডের চাহিদা রয়েছে। দেশে প্রায় ৫৫টি অটো স্টিল রি-রোলিং মিল এবং ১০০টিরও বেশি সেমি-অটো এবং ম্যানুয়াল মিল এই রড সরবরাহ করে। যদিও কয়েকটি বড় কোম্পানি উচ্চ-গ্রেডের মানের ইস্পাত পণ্যের বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে ধীরে ধীরে আমদানি-নির্ভরতা কমিয়েছে।

বিএসআরএম পদ্মা সেতুর জন্য ৫০ এমএম রড উৎপাদন করেছে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমদানি করে এই রডের চাহিদা পূরণ করা হতো।

উদ্বেগের বিষয় কাঁচামাল আমদানি 

বিএসএমআরএমের কোম্পানি সেক্রেটারি শেখর রঞ্জন কর বলেন, এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে কোনো বিঘ্ন ঘটছে না। কিন্তু কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে তারা এখনও সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

বিএসআরএমের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, দেশের ইস্পাত বাজারে অবস্থান সুসংহত করতে এবং মানসম্পন্ন ইস্পাত পণ্যের ক্রমবর্ধমান বাজার চাহিদা মেটাতে কোম্পানিটি তাদের বার্ষিক রোলিং সক্ষমতা ৬ লাখ টন এবং মেল্টিং সক্ষমতা ২.৫ লাখ টন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় বিএসআরএম লিমিটেড গত অর্থবছরের জন্য তাদের শেয়ারহোল্ডারদের ২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার সুপারিশ করেছে।

আরও পড়ুন

আমদানিকারকদের একমাত্র ভরসা আগাম ডলার

২০২১-২২ অর্থবছরে বিএসআরএম তাদের শেয়ারহোল্ডারদের ৩৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল।

২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বিএসআরএমের প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ফ্লোর প্রাইস ৯০ টাকায় আটকে আছে।

এছাড়াও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিএসআরএম লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড গত অর্থবছরের জন্য তাদের শেয়ারহোল্ডারদের ২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার সুপারিশ করেছে।

ওই অর্থবছরে কোম্পানিটির আয় আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৮ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা হয়েছে।

কিন্তু আগের অর্থবছরের তুলনায় এর নিট মুনাফা ৯ শতাংশ কমে ২৯৭ কোটি টাকা হয়েছে।

সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড