কোনোভাবেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। বরং হু হু করে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গত ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। আর ৬ মাসে বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া ১ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তাদের মতে, খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না। এদিকে খেলাপি ঋণ ঠেকাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ পরিশোধে দেয়া হচ্ছে বিশেষ ছাড়, অফার করা হচ্ছে নানা সুযোগ-সুবিধা।

কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। 

জানা গেছে, মহামারি করোনার প্রকোপের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। গ্রাহককে ঋণ শোধ না করেও ঋণখেলাপি থেকে মুক্ত রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কম সুদে ঋণ নেয়া ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল ২০২২ সালেও। চলতি বছরও ঋণের কিস্তির অর্ধেক পরিশোধে রয়েছে বিশেষ ছাড়। এমন সব সুযোগের পরও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না গ্রাহক। যার কারণে নানা উদ্যোগ নিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।


বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণ পুনর্গঠন, ঋণ অবলোপন এবং অর্থঋণ আদালতে মামলায় ঝুলে থাকা সব ঋণ হিসাবে নিলে প্রকৃত খেলাপি সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার কম হবে না। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক দেখাচ্ছে মাত্র ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এটা সঠিক নয়। 

তিনি বলেন, উচ্চ ঋণখেলাপি থেকে বাঁচতে হলে একটা ঋণখেলাপি ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। সে ট্রাইব্যুনালে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির বিচার করতে হবে। খেলাপিদের জেলে পাঠাতে হবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০.১১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ৩ মাস আগেও মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। প্রথম ৩ (জানুয়ারি-মার্চ) মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া এক বছরে অর্থাৎ গত বছরের জুনের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, যদি কোনো গ্রাহক চলতি বছরের জুনের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দেয় সে খেলাপি হবে না। ফলে যারা ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ না করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তারা কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হওয়ার সুযোগ পান। তবে শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেয়া হয়। সাধারণত ব্যবসা শুরু বা শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে মেয়াদি ঋণ নেয়া হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, খাতা-কলমে দেখানো হচ্ছে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে এই অঙ্ক অনেক বেশি। কারণ এখানে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণের হিসাব নেই, এগুলো যোগ করলে খেলাপি আরও বাড়বে। তিনি জানান, খেলাপি ঋণ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা মানে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। এতে করে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে। করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, এখন সুবিধা বন্ধ করে খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে হবে। কঠোর অবস্থায় যাওয়া ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প উপায় নেই। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণখেলাপিরা শাস্তির বদলে তারা উল্টো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। বিদেশে ঋণখেলাপিদের সবকিছু কেড়ে নেয়া হয়। আর এখানে তার উল্টো। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাতটি শেষ হয়ে যাবে।

জানা গেছে, ডলার সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। ধাপে ধাপে ঋণ ছাড়ের ক্ষেত্রে সংস্থাটি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। সব শেষ প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের হার ১০.১১ শতাংশ। আর সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হারও নির্ধারিত মাত্রার অনেক উপরে। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

সুত্র-মানবজমিন 

৩ অক্টোবর ২০২৩