দেশের মোট রফতানি আয়ে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান ৮০ শতাংশেরও বেশি। কর্মসংস্থানের দিক থেকেও তৈরি পোশাক এখন দেশের বৃহত্তম খাত। শিল্পটিকে এখন দেখা হয় বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে। যদিও দেশের মোট জিডিপিতে তৈরি পোশাকের নিট রফতানির অবদান খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের মোট জিডিপিতে তৈরি পোশাক খাতের নিট রফতানির অবদান ৫ শতাংশেরও কম।আয়কর অব্যাহতি, ব্যাংক খাত বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে (ইডিএফ) ঋণ অর্থায়নসহ নানা ধরনের নীতিগত ছাড় ও সুবিধা পেয়ে থাকে তৈরি পোশাক খাত। এসব নীতি সহায়তার সুবাদে খাতটির সম্প্রসারণ হলেও জোরালো হয়নি জিডিপিতে তৈরি পোশাকের নিট রফতানির অবদান।

বিশ্বব্যাপী রফতানি খাতের প্রকৃত অবদানকে বিশ্লেষণ করা হয় নিট রফতানির হিসাবে। পণ্যের মোট রফতানি থেকে কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বাদ দেয়ার পর পাওয়া অবশিষ্ট অংককে বলা হয় নিট বা প্রকৃত রফতানি। আবার দেশের মোট জিডিপিতে নিট রফতানির অবদানকে দেখা হয় বাণিজ্য খাতের পরিস্থিতি পর্যালোচনার অন্যতম সূচক হিসেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের মোট রফতানি ছিল ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের কিছু বেশি। সেখান থেকে প্রায় ১ হাজার ৯৪৪ কোটি ডলারের কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বাদ দিলে নিট রফতানির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৩১৭ কোটি ডলারে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত অর্থবছরে জিডিপির মোট প্রক্ষেপিত পরিমাণ ৪৬ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার। সে হিসেবে দেশের মোট জিডিপিতে তৈরি পোশাক খাতের নিট রফতানির অবদান দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশে।

বৈশ্বিক অর্থনীতির নানা দুর্বিপাকেও গত অর্থবছরে (২০২১-২২) বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের মোট ও নিট রফতানি বেড়েছে। কিন্তু গত প্রান্তিক তথা চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মোট ও নিট রফতানি—দুটোরই পরিমাণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় কমেছে। আগের প্রান্তিকের (২০২১-২২ অর্থবছরের এপ্রিল-জুন) ১ হাজার ১১৮ কোটি ডলার থেকে এ সময় রফতানি নেমে এসেছে ১ হাজার ২৭ ডলারে। একই সঙ্গে নিট রফতানির পরিমাণ ৬০৪ কোটি ডলার থেকে কমে হয়েছে ৫২৯ কোটি ডলারের কিছু বেশি। সে হিসেবে গত প্রান্তিকে তৈরি পোশাক খাতের নিট রফতানি কমেছে আগের প্রান্তিকের তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশেরও বেশি।

তৈরি পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গোটা বিশ্বেই এখন কাঁচামালের দাম বাড়তির দিকে। একই সঙ্গে গোটা সরবরাহ চেইনের প্রতিটি স্তরেই ব্যয় বেড়েছে। গত প্রান্তিকে নিট রফতানি কমে আসার পেছনে মূলত এ দুটি বিষয় সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পোশাক খাতের উৎপাদন ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের কাঁচামালের দাম আসলে অনেক বেড়ে গেছে, যার প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি। যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তুলা ও সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের নিট রফতানিও কমে গেছে। মূল বিষয় হচ্ছে গোটা বিশ্বই এখন এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শুধু পোশাক খাত নয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অন্যান্য খাতেও পণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। গোটা সরবরাহ চেইনেই সব জিনিসপত্রের দাম বেশি। আমরা এখন মোট রফতানির হারটা ধরে রাখছি। কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায় এখন মূল্য সংযোজনের হারও কমে গেছে। এখন আমরা স্থানীয়ভাবে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা পশ্চাৎ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছি। আগে যত সুতা আমদানি হতো, এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এদিক থেকে মূল্য সংযোজন বাড়ানো যাচ্ছে। তাই বছরের শেষে দেখা যাবে, গত বছরের তুলনায় মূল্য সংযোজন যতটুকু কমছে, সেটিও পূরণ হয়ে আসবে।

গত প্রান্তিকে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানির প্রধানতম গন্তব্য দেশগুলো ছিল যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, কানাডা ও বেলজিয়াম। দেশগুলোয় মোট রফতানির প্রায় ৮৯ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক, যার পরিমাণ ছিল ৭৪২ কোটি ২৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে আবার অধিকাংশই ছিল নিটওয়্যার। গত প্রান্তিকে এ নয় দেশ থেকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি বাবদ আয় কমেছে সাড়ে ৯ শতাংশের কিছু বেশি।

এ সময় নিট রফতানি কমে আসার পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ার পাশাপাশি প্রস্তুতকৃত পণ্যের বহির্মুখী চালান কমে যাওয়ার বিষয়টিও কাজ করেছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, অনেক পণ্যই এ সময় প্রস্তুতকৃত অবস্থায় গুদামে যুক্ত হলেও এগুলোর চালান বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়নি। আবার রফতানি কিছুটা স্থবির হলেও এ সময় পোশাক খাতের শিল্পোদ্যোক্তাদের কাঁচামাল আমদানি অব্যাহত ছিল।

তৈরি পোশাক খাতের নিট পণ্য প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, নিট রফতানি কমার কারণ হলো আমাদের মোট রফতানিও কমেছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর-পরবর্তী সময়ে অনেক পণ্য প্রস্তুত হয়েছে, কিন্তু রফতানি হয়নি। এগুলো আমাদের কাছে মজুদ রয়ে গেছে। এখনো অনেক পণ্য মজুদ রয়েছে যেগুলো শিপমেন্টে যাওয়ার কথা ছিল। সেপ্টেম্বরে আমাদের প্রবৃদ্ধির ধারা ছিল নেতিবাচক, মাইনাস সাড়ে ৭ শতাংশ। পণ্য শিপমেন্টে যায়নি ঠিকই, কিন্তু আমাদের আমদানি চালু ছিল, যা নিট রফতানি কমে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ। আরেকটি কারণ হলো বিভিন্ন কারণে আমাদের কাঁচামালের ব্যয় বেড়ে গেছে। আর ব্যয় বাড়ায় মূল্য সংযোজনও স্বাভাবিকভাবে কমে যাবে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বৈশ্বিক বাজারের ধরনটিকে এখানকার অর্থনীতির জন্য খুব একটা সহায়ক হিসেবে দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব শুরুর পর পরই বিষয়টি বেশ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। এ দেশে তৈরি পোশাক খাতে পণ্যের মূল্য সংযোজন হয় তুলনামূলক কম। বৈচিত্র্যও তেমন একটা নেই। ২০১৯ সালের শেষার্ধ থেকেই এ শিল্পে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। কভিডের প্রাদুর্ভাব সমস্যাগুলোকে আরো জটিল করে তোলে। এর মধ্যেই ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় রাশিয়া এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুইফটের পেমেন্ট মেসেজিং নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে দেশটিতে পণ্য রফতানি করাও অত্যন্ত মুশকিল হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে রফতানিকারকরাও পণ্যের গন্তব্য তালিকা থেকে দেশটির নাম বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন।

অন্যদিকে ভিয়েতনামের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে তৈরি পোশাকের বাজার নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা এখন বাড়ছে। দেশের তৈরি পোশাক খাতের মোট রফতানির প্রায় ৮০ শতাংশ যায় ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোয়। বর্তমানে এ বাণিজ্যের পথে বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে ভিয়েতনামের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি। অন্যদিকে দেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রধানতম গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রও এখন পোশাক আমদানিতে উৎস দেশ হিসেবে ভিয়েতনামকেই প্রাধান্য দিচ্ছে বেশি। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশীদের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ আয় করছেন ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক রফতানিকারকরা।

আবার রফতানি খাত শুধু তৈরি পোশাক শিল্পনির্ভর হয়ে পড়ায় তা সার্বিকভাবে গোটা অর্থনীতির জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, দেশের রফতানি খাতের মোট আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। অনুকূল পরিবেশে তৈরি পোশাক শিল্প বড় হলেও রফতানিমুখী অন্যান্য ভারী ও হালকা শিল্প এখনো সেভাবে বিকশিত হয়ে ওঠেনি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট পণ্য রফতানি হয়েছে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এর মধ্যে তৈরি পোশাকই আছে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের কিছু বেশি। রফতানি খাত এক জাতীয় পণ্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় বৈদেশিক আয়ের পথকে সংকুচিত করার পাশাপাশি সার্বিকভাবে অর্থনীতিকেই হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমনকি দেশের মোট জিডিপিতে রফতানি খাতের অবদান কমে আসার পেছনেও অর্থনীতিবিদরা পোশাক শিল্পে অতিনির্ভরতাকে দায়ী করছেন।

ইপিবি ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছরে দেশের মোট জিডিপিতে রফতানির অবদান ছিল ১১ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরেও এ হার ছিল ২০ শতাংশের বেশি। দেশের মোট জিডিপিতে রফতানি খাতের অবদান এভাবে দিনে দিনে কমে আসার বিষয়টিকে অর্থনীতির জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে পণ্যের বৈচিত্র্যায়ণ ও গন্তব্যের প্রসার প্রয়োজন বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রফতানি আয়ের সিংহভাগই তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল—এটি অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ। পণ্য ও গন্তব্যের বৈচিত্র্যায়ণ না হওয়ায় গত এক দশকে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে রফতানি আয় বাড়ানো সম্ভব হয়নি। উল্টো আমদানি ব্যয় বেড়েছে অনেক। এর ফলে অর্থনীতিতে একধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। আমাদের তৈরি পোশাকের প্রধান ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। এখন এ দুই গন্তব্যের কোনো একটি যদি ভূরাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে, তাহলে রফতানি আয়ে মারাত্মক ধস নামবে। এজন্য রফতানির ক্ষেত্রে পণ্য ও গন্তব্যের বৈচিত্র্যায়ণ এবং প্রসার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ফিশারিজ ও চামড়া শিল্পে বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি তৈরি পোশাককেন্দ্রিক যেসব আমদানি ব্যয় রয়েছে, সেগুলো কমিয়ে আনার জন্য স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।’

সূত্র-বণিক বার্তা

আরও পড়ুন

ডলার সংকট এড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সেল

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্বল কর ভিত্তি বাংলাদেশের

একটি দেশ কি দেউলিয়া হতে পারে?