সারা পৃথিবীতে এক আতঙ্কের নাম ক্ষতিকর ধাতব এবং প্লাস্টিকদূষণ। মুরগি, মাছ, মাংস, সবুজ শাকসবজির মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে সীসা, ক্রোমিয়াম, মাইক্রোপ্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ যা মানবদেহে ক্যানসার সৃষ্টির কারণ। আকারে ক্ষুদ্র হওয়ায় এসব পদার্থ মাটি, পানি বা বাতাসের সঙ্গে সহজেই মিশে যাচ্ছে। ফলে সহজেই প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়ছে এসব ক্ষতিকর ধাতব ও মাইক্রোপ্লাস্টিক।

খাদ্যশৃঙ্খলের প্রথম স্তরের খাদককে দ্বিতীয় স্তরের খাদক ভক্ষণ করে; দ্বিতীয় স্তরের খাদককে তৃতীয় স্তরের খাদক ভক্ষণ করে; তৃতীয় স্তরের খাদককে সর্বোচ্চ স্তরের খাদক ভক্ষণ করে। এভাবে খাদ্যশৃঙ্খলের পর্যায়ক্রমিক পরিক্রমায় ক্ষতিকর ধাতব এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করছে। ফলে ক্ষতিকর ধাতব এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে দিনে দিনে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে জামালপুর জেলার কুড়িটি এলাকায় চাষ করা বেগুনে ক্ষতিকর সীসা, ক্যাডমিয়াম ও নিকেলের উপস্থিতি রয়েছে। এর আগে নানা সময়ে মুরগি, মাছ, দুধ, হলুদের গুঁড়াতেও ক্ষতিকর ধাতবের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কিছু খাদ্যে মাত্রার চাইতে বেশি পারদ ও আর্সেনিক পাওয়া নিয়েও কথা হয়েছে। খাদ্যে এসব ধাতব পদার্থ মাত্রার চাইতে বেশি থাকলে এবং নিয়মিত খেলে তা মানুষের শরীরে নানা ধরনের জটিল অসুখ তৈরি।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আসাদুজ্জামান খান এ প্রসঙ্গে গবেষণা করেছেন। তিনি বলছেন, কৃষি পণ্যে ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ আসতে পারে মাটি ও পানি থেকে। কোন নির্দিষ্ট সবজি বা গাছের সাথে এর সম্পর্ক নেই।বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "মাটি বা পানিতে নানা কারণে এসব ধাতব পদার্থের দূষণ হতে পারে। যেমন কোন কারখানা থেকে নিয়মিত যদি বর্জ্য পরিশোধন না করে মাটিতে ফেলা হয়, সেই মাটিতে আপনি যা চাষ করবেন ওই বর্জ্যে যেসব ধাতব পদার্থ থাকবে সেই ফসলে ওই সেসব পাওয়া যেতে পারে।"

আরও পড়ুন

কৃষিই হতে পারে দেশের সমৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি

যদি সেই বর্জ্য পানিতে ফেলা হয় এবং ঐ পানি যদি কৃষিতে সেচের কাজে ব্যাবহার করা হয় তাহলে ফসলে ওই বর্জ্যে উপস্থিত ধাতব পাওয়া যেতে পারে। আবার পানিতে ধাতব পদার্থের দূষণ থাকলে সেটা ধীরে ধীরে আশপাশের মাটিকেও দুষিত করে ফেলে।অধ্যাপক খান বলেন, তিনি বাংলাদেশের আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায় ধানে আর্সেনিক পেয়েছেন। যেসব এলাকায় শিল্পদূষণ বেশি তার আশপাশে চাষ করা কৃষিপণ্যে ক্ষতিকর ধাতব বেশি পাওয়া গেছে।

আয়তনে ছোট হওয়ার কারণে এবং কৃষি জমি কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে কৃষি জমির আশপাশে শিল্প কারখানা খুবই নিয়মিত দেখা যায়। অন্যদিকে নদী বা জলাশয়ে পরিশোধন না করেই বর্জ্য ফেলার প্রবণতাও বাংলাদেশে ব্যাপকহারে রয়েছে। এখন নির্দিষ্ট একটি এলাকার বেগুনে ক্ষতিকারক ধাতব পাওয়া গেছে তার অর্থ এই নয় যে সারা দেশে সকল বেগুনে তা পাওয়া যাবে। ফসলটি কোথায় চাষ করা হচ্ছে, সেখানকার মাটি কেমন বিষয়টি তার উপর নির্ভর করবে।

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ খাদ্য ও কৃষি নিয়ে গবেষণা করছে উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা, উবিনিগ। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বলছেন, খাদ্যে ধাতবের আরও তিনটি উৎস হল কিছু সার, কীটনাশক, আগাছা নিধনকারী ঔষধ এবং বায়ু দূষণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ১৩টি কীটনাশক আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ। সেগুলোর বেশ কয়েকটি বাংলাদেশে অবাধে বিক্রি হচ্ছে, ব্যবহৃত হচ্ছে। কোন ধরনের সরকারি নজরদারি নেই। ডিলাররা যেভাবে বলে দিচ্ছে কৃষকেরা সেভাবে ব্যাবহার করছে। যার মাত্রা প্রায়শই বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া হাইব্রিড ফসলে কীটনাশক বেশি দিতে হয়। এসব কারণে মাটিতে ক্ষতিকর ধাতব বেশি পাওয়া যায়। বাতাসে যদি সীসা বেশি থাকে তাহলে ফসলে তার উপস্থিতি পাওয়া যেতে পারে।

গবেষকদের মতে, অসময়ে অন্য মৌসুমের সবজি চাষেও কীটনাশক ও সার বেশি দেবার প্রবণতা রয়েছে। বাংলাদেশে ব্যবহৃত নিষিদ্ধ এরকম কয়েকটি কীটনাশক হচ্ছে প্যারাকোয়াট, ডিডিটি এরকম কয়েকটি কীটনাশক।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পুরনো দিনের কিছু কীটনাশক যেগুলো কম দামে পাওয়া যায় সেগুলো দীর্ঘদিন মাটিতে থেকে যেতে পারে, পানি দূষণের কারণ হতে পারে। একই জমিতে বছরের পর বছর এসব কীটনাশক ব্যবহার করলে সেটি ঘটতে পারে।

উন্নয়নশীল, অনুন্নত দেশ এবং খাদ্যে ঘাটতি রয়েছে এমন দেশগুলোতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে এসব কীটনাশক সহায়তা করলেও তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।কাছাকাছি সময়ে বেগুন ছাড়াও নানা সময়ে আরও বেশ কিছু খাদ্যে ক্ষতিকর ধাতব পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে হলুদের গুঁড়াতে অতিমাত্রায় ক্ষতিকারক সীসার উপস্থিতি পাওয়ার পর হলুদ রপ্তানি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল।

সেসময় বেশ কয়েকটি বড় বড় কোম্পানির হলুদের গুঁড়াতে এর উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। বিক্রির আগে হলুদের গায়ে সীসা ঘষে সেটি উজ্জ্বল করার কারণে হলুদের গুঁড়োতেও সীসা পাওয়া যাচ্ছিল।একই বছর দুধে সীসাসহ ভারী ধাতুর উপস্থিতি সম্পর্কে জানা যায়। মুরগি ও মাছ চাষে ট্যানারির বর্জ্য থেকে তৈরি খাবার দেয়ার বিষয়টি জানা গেছে কয়েক বছর আগে। এসব ধাতব পদার্থের উপস্থিতি নিয়ে সেসময় বেশ উদ্বেগ তৈরি হয়।

পরিপাকতন্ত্রের নানা রোগ বিষয়ে চিকিৎসক গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ বলেন, খাদ্যে এসব ক্ষতিকর ধাতবের উপস্থিতি সহনশীল মাত্রার ভেতরে আছে কিনা সেটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

"যেসব ক্ষতিকর ধাতব নিয়ে এখন আলোচনা চলছে সেগুলো যদি আপনি একদিন একটু বেশি খেয়ে ফেলেন তাহলে হয়ত পেটে ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া হতে পারে। কিন্তু যদি নিয়মিত সেটা পেটে যায় তাহলে তার প্রভাব মারাত্মক হবে। যেমন আপনার লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্যান্সার হতে পারে। খাদ্য যে জায়গা থেকে প্রবেশ করে, পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশে যায় সেসব অংশে ক্যান্সার হতে পারে", বলছিলেন ডা. ফারুক আহমেদ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃতিতে অল্প পরিমাণে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু দূষণের কারণে প্রকৃতিতে তা এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যাডমিয়াম কিডনি, হাড় ও শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি করে।সীসা সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে শিশুদের। মাত্রার চেয়ে বেশি সীসা শিশুদের শরীরের বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। এছাড়া, খাবারে অরুচি, ওজন কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ - এরকম নানা সমস্যা তৈরি করে।

পারদ শরীরে বেশি প্রবেশ করলে তা স্নায়ু, পরিপাকতন্ত্র, কিডনি, ফুসফুস ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষতি করে।সাধারণত মাটিতে বা মাটির সংস্পর্শে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, টাইটেনিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, নিকেল, কপার, জিংক, ভ্যানাডিয়াম থাকে। এর মধ্যে আয়রন থাকে সর্বোচ্চ ৪২ হাজার পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), ক্যালসিয়াম ১ হাজার ২০০ পিপিএম এবং অন্যান্য পদার্থ থাকে ৫ হাজার পিপিএম’র কম পরিমাণে। এসব পদার্থ পানি, বিভিন্ন উপায়ে দূষিত বায়ুমণ্ডল এবং খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে আমাদের শরীরে ঢুকছে।

মাছ মাংসে যে বিষ রয়েছে তার প্রমাণ মিলেছে অনেক আগেই। উৎপাদন বাড়াতে বহু মাছ, পশু এবং হাঁস মুরগির খামারে ব্যবহার করা হচ্ছে চামড়া শিল্পের বর্জ্য। এগুলিতে থাকে মাত্রারিক্ত ক্রোমিয়াম। সাধারণত মাছ, মুরগি কিংবা কোন মাংস রান্না করলে ক্রোমিয়াম সহজে নষ্ট হয় না। কারণ এদের সহনীয় ক্ষমতা প্রায় ২৯০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আর আমরা রান্না করি মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপে।

মাছের শরীর থেকে বিষ সরাসরি ঢুকবে আপনার শরীরে। যার ফলে স্থায়ীভাবে বিকল হয়ে যেতে পারে কিডনি। অকেজ হয়ে যাবে লিভার। মস্তিষ্কসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও ক্ষতি হতে পারে। এমনকি ক্রোমিয়াম শরীরের কোষ নষ্ট করে দেয়। পরবর্তীকালে যা ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতিদিন ট্যানারিতে প্রায় ১০০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয় যা রিসাইক্লিং করে ব্যবহার করা হয় মুরগি এবং মাছের খাবার হিসেবে।

 

অপরদিকে মাছ সংরক্ষণ করতে ব্যবহার করা হয় ফরমালিন। এটি হলো একটি অত্যন্ত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। এমনকি এই ফরমালিন মর্গে মৃত দেহ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা এবং আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফরমালিনকে মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক একটি রাসায়নিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই ফরমালিনের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিডনি এবং লিভার। এর ফলে কোন ব্যক্তি কোমাতেও চলে যেতে পারেন।

গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ৭৩ শতাংশ মাছের শরীরেই রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক কিংবা প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা। যা মানুষের শরীরে ধীরে ধীরে স্লো পয়জন ঘটায়। আপনিও বুঝতেও পারবেন না কখন মৃত্যু শিয়রে এসে হাজির হয়েছে। শুধু কি প্লাস্টিক? মাছের শরীরে জলাশয় কিংবা সমুদ্র থেকে ঢুকে যায় পারদ, সীসা, ক্রোমিয়ামের মত ক্ষতিকারক রাসায়নিক। তারপর মাছ সংরক্ষণের জন্য বেআইনিভাবে ব্যবহার করা হয় ফরমালিন। এগুলো যে প্রাণঘাতী রোগের মোক্ষম কারণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

চিকিৎসকের মতে, ভারী ধাতব পদার্থ বিশেষ করে সীসা শরীরে এন্টি অক্সাইডের যে জৈবিক ক্রিয়া আছে তা ঘটতে দেয় না। ফলে সরাসরি দেহের কোষের ক্ষতি করে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় অস্থিমজ্জা এবং লিভার ও কিডনি। অস্থিমজ্জা নষ্ট হওয়াতে রক্তের লোহিত কণিকা উৎপন্ন হওয়ায় বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি রক্তশূন্যতায় ভোগে। তাছাড়াও শ্বেত কণিকা উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শরীরে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বিঘ্নিত হয়। ফলে ঘন ঘন রোগের সংক্রমণ দেখা দেয়, এমনকি ক্যানসার হতে পারে।

সূত্র-ঢাকাটাইমস

আরও পড়ুন

টিকে থাকতে হলে শিখতেই হবে সপ্তাহে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা

মিয়ানমারের পরমাণু বোমা

বিশ্বনবির হাসি-খুশি ও রসিকতার ধরন কেমন ছিল?