যেকোনো দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত হলো— স্থিতিশীলতা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সংশ্লেষে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়, এসব অপরাধকে বলা হয় সাইবার অপরাধ। কম্পিউটার, বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ফরম, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তির আবিষ্কার ও এর বহুল ব্যবহার বিজ্ঞানের উত্কর্ষের পরিচায়ক। কম্পিউটার প্রযুক্তি উন্নত দেশগুলোয় অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলে এত ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয় যে, তা নথি ও খাতা-কলমের ব্যবহার শূন্যের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। আমাদের দেশে অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলপর্যায়েও শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার ব্যবহারে বেশ আগ্রহী। কিন্তু আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় সব শিক্ষার্থীর পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে কম্পিউটার সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

বর্তমানে উন্নত দেশগুলোর সব তথ্য কম্পিউটারে সংরক্ষিত থাকায় কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সংরক্ষিত তথ্যের বিনাশ বা ক্ষতিসাধন সম্ভব। কম্পিউটার সিস্টেমে রক্ষিত এরূপ তথ্যের বিনাশ বা ক্ষতিসাধন করা হলে তা একটি দেশের জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এসব বিষয় চিন্তা করে বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত নির্বিভেদে সব দেশে সাইবার অপরাধ রোধে তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিচার্য। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যাতে কম্পিউটারে সংরক্ষিত তথ্য বিনষ্ট করা না যায়, সে বিষয়ে উন্নত দেশগুলো সচেষ্ট। তার পরও দেখা যাচ্ছে, হ্যাকিং প্রতিরোধে নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হলেও হ্যাকাররা সেটি ভেঙে প্রবেশ করছে অনলাইনের মাধ্যমে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনগত বৈধতা ও নিরাপত্তা প্রদান এবং এর অপব্যবহার রোধে আমাদের দেশে ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনটির ৫৪ ধারা কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির অনিষ্ট সাধন-সংক্রান্ত; ৫৬ ধারা কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাকিংয়ের অপরাধ-সংক্রান্ত; ৫৭ ধারা ইলেট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশের অপরাধ-সংক্রান্ত এবং ৬১ ধারা সংরক্ষিত সিস্টেমে প্রবেশের অপরাধ-সংক্রান্ত। আইনটি প্রণয়নকালে উল্লিখিত চারটি ধারার অপরাধ অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য ছিল। ২০১৩ সালে আইনটিতে সংশোধনী এনে চারটি ধারার অপরাধ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য করা হয়েছে। তাছাড়া সংশোধন-পরবর্তী চারটি ধারার সাজা সর্বোচ্চ ১৪ বছর এবং ন্যূনতম সাত বছর করা হয়। উল্লেখ্য, সংশোধনের আগে চারটি ধারায় সাজার মেয়াদ ছিল অনধিক ১০ বছর।

বিশ্বের সব দেশেই রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মের প্রভাব রয়েছে। যেকোনো দেশে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ধর্মকে কটাক্ষ করে কোনো বক্তব্য দিলে তা দেশে অরাজক ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের মূল দণ্ডবিধিতে ধর্ম অবমাননা বিষয়ে অপরাধের সাজা সীমিত হওয়ায় তা কার্যকরভাবে ধর্ম অবমাননা-সংক্রান্ত অপরাধ হ্রাসে ভূমিকা রাখতে না পারায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ও ৬৬ ধারায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে যেকোনো ধর্মের অবমাননা শাস্তিযোগ্য করা হয়।

আইনটির ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসত্ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এ কার্য হবে একটি অপরাধ।

উল্লিখিত ধারায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধকল্পে কঠোর সাজার বিধান করা হলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতায় তা ক্ষেত্রবিশেষে কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কম্পিউটার বিষয়ে যাদের বিশেষ জ্ঞান আছে, তারা নিশ্চয়ই অবগত যে, কম্পিউটারে একজন প্রকৃত ব্যক্তির নামে তার অজান্তে সহজেই ফেসবুক আইডি খোলা যায় এবং ওই ফেসবুক আইডিতে তথ্য বা ছবি আপলোড করা যায়। এমনো দেখা যায়, প্রকৃত ব্যক্তির অজান্তে তার নামে খোলা ভুয়া ফেসবুক আইডিতে অবমাননাকর সংবাদ ও অশ্লীল ছবি প্রকাশ করে তার জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়, যদিও এসব বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা বা সংশ্লেষ থাকে না। এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তত্পর হলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মূল অপরাধীকে শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব।

আইনটির ৬৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কম্পিউটার, ই-মেইল বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা রিসোর্স বা সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংগঠনে সহায়তা করে, তাহলে তার উক্ত কার্য হবে একটি অপরাধ এবং অপরাধ সংগঠনে সহায়তা করার ক্ষেত্রে মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত করা আছে, সহায়তাকারী ব্যক্তিও সমরূপ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

প্রায়ই দেখা যায়, ফেসবুক, ব্লগ, ইউটিউব, টুইটার প্রভৃতিতে মিথ্যা, অশ্লীল ও অবমাননাকর ছবি এবং সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এসব সংবাদ ও ছবি প্রকাশের পেছনে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। আর উদ্দেশ্যটি হলো, কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা দলকে জনসম্মুখে অবমাননা ও হেয় করা। এসব মাধ্যম ব্যবহারকারীর অনেকে না বুঝে এ ধরনের ছবি ও সংবাদে লাইক প্রদান বা তা শেয়ার করেন। এভাবে কেউ মিথ্যা, অশ্লীল ও অবমাননাকর সংবাদ ও ছবিতে লাইক দিলে বা শেয়ার করলে অপরাধটির সহায়তাকারী হিসেবে তার সাজা বা দণ্ড, যিনি মূল সংবাদ ও ছবিটি আপলোড করেছেন, তার সমরূপ।

আমাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে হ্যাকিং প্রতিরোধে যে বিধান করা হয়েছে, তাতে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি যদি জনসাধারণের বা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে বা ক্ষতি হবে মর্মে জ্ঞাত হওয়া সত্ত্বেও এমন কোনো কার্য করে, যার ফলে কোনো কম্পিউটার রিসোর্সের কোনো তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা উপযোগিতা হ্রাস পায় বা অন্য কোনোভাবে এর ক্ষতিসাধন করে অথবা মালিক বা দখলদার না হওয়া সত্ত্বেও কোনো কম্পিউটার, সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করার মাধ্যমে এর ক্ষতিসাধন করে, তাহলে তার এ কাজ হবে একটি হ্যাকিং অপরাধ।

আমাদের দেশেও অধুনা ব্যাংকের লেনদেন-সংক্রান্ত যাবতীয় হিসাব কম্পিউটারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। কাজটি সম্পন্নের জন্য প্রতিটি ব্যাংকের পৃথক সিস্টেম রয়েছে। তাছাড়া অনলাইন ব্যাংকিংয়ের কারণে এখন একই ব্যাংকের যেকোনো শাখায় টাকা জমা দেয়া ও উত্তোলন করা যায়। এসব সিস্টেমের দুই বা তিন স্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকলে এটি ভেদ করে ক্ষতিসাধন করা যাবে না— এমন জোর দাবি করা বোধকরি সঙ্গত নাও হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত একাধিক ঘটনা তারই প্রমাণ। আর তাই হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সিস্টেমের যেন কোনো ক্ষতিসাধন না হয়, সে বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষসহ সিস্টেম ব্যবহারকারীকে সতর্ক থাকতে হবে।

যেকোনো ধরনের অপরাধ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। আর তাই যেকোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে সাজা প্রদানের দায়িত্বটি রাষ্ট্র পালন করে থাকে। সাইবার অপরাধ এক ধরনের বিশেষায়িত অপরাধ। সাধারণ আইনে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়, তার বিচার পদ্ধতি কী হবে, সেটি ফৌজদারি কার্যবিধিতে উল্লেখ রয়েছে। সাইবার অপরাধসহ অধিকাংশ বিশেষায়িত আইনের অধীন কৃত অপরাধের বিচার পদ্ধতি, আমলযোগ্যতা ও জামিনযোগ্যতার বিষয় সাধারণ আইনের চেয়ে ভিন্নতর।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৬, ৬৭ ও ৬১-এ চারটি ধারা  ব্যতীত অপরাপর ধারায়ও অপরাধ ও সাজার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এসব ধারার অপরাধ অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য হওয়ায় গুরুত্ব বিবেচনায় এগুলো ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারার অপরাধের ন্যায় ব্যাপকতর নয়। তাছাড়া অ-আমলযোগ্য হওয়ায় এসব ধারার অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ব্যতিরেকে পুলিশের পক্ষে অপরাধীকে আটক করা সম্ভব নয়।

দেশে বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণীত হয়েছে এবং এ আইনের অধীন কৃত অপরাধের বিচারের জন্য পৃথক সাইবার ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার বিধান করা হয়েছে। এ ধরনের ট্রাইব্যুনাল বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। সর্বশেষে বলতেই হবে, সব অপরাধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে।

লেখক: সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.

source: bonikbarta

DISCLAIMER : Views expressed above are the author's own. The contents provided here are only for educational assistance & information purposes only. Information is provided without warranty and is to be used at the risk of the reader. All trademarks, logos and copyright issues are property of their respective owners. The creator of this page takes no responsibility for the way you use the information provided on this site.