ড. মনজুর হোসেন | ২০১৫-০১-১২ ইং

২০১৪ সাল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কেমন ছিল এবং নতুন বছরে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি কেমন হতে পারে— তেমন বিশ্লেষণ নতুন বছরের শুরুতে করা যেতেই পারে। এ আলোচনায় সামষ্টিক অর্থনীতির কিছু সূচকের বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে নতুন বছরের জন্য পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হলো। এ বছর ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছর এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। এ অবস্থায় লক্ষ্যমাত্রার কতটুকু অর্জন হলো এবং যেসব জায়গায় ঘাটতি রয়েছে, তার বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা করা হলে তবেই তা বাস্তবসম্মত হবে। যদিও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দা চলছিল, তার পরও বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির কিছুটা উচ্চ লক্ষমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছিল মূলত বৈশ্বিক এ মন্দাভাব দ্রুত তিরোহিত হবে— এ ধারণা থেকেই। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি এবং বৈশ্বিক মন্দাভাব প্রলম্বিত হয়েছে। বৈশ্বিক মন্দাভাব এবং দেশীয় রাজনীতির অস্থিরতা মিলে পরিকল্পনার শেষ বছরগুলোয় আমাদের অর্থনীতির জন্য প্রাক্কলিত ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনও সম্ভব হয়নি। ফলে গত কয়েক বছরই বাজেট প্রাক্কলনের সময় লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরে এসে জিডিপি প্রবৃদ্ধির কিছুটা নিম্ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সে লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন হয়নি। এর কারণগুলোই মূলত এ নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত দুই বছর ৬ শতাংশের কাছাকাছি আটকে আছে। ২০১২-১৩ সালে ৭ দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ এবং গত অর্থবছরে (২০১৩-১৪) ৭ দশমিক ২ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কেমন হবে তা আলোচনার আগে বিগত বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম প্রবৃদ্ধি অর্জনের কারণ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম প্রবৃদ্ধি অর্জন হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ— কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম বিনিয়োগ হওয়া, বিশেষ করে বেসরকারি ও বৈদেশিক বিনিয়োগে স্থবিরতা। অর্থনীতিতে একটি নির্দিষ্ট হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করার জন্য কতটুকু বিনিয়োগ হওয়া প্রয়োজন, তা হ্যারড-ডোমার মডেল ব্যবহার করে অনুপাত প্রাক্কলনের মাধ্যমে জানা যেতে পারে। এ অনুপাতকে আয়কর (ICOR: Incremental Capital-Output Ratio) বলা হয়। যদিও হ্যারড-ডোমার মডেলের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবুও এ মডেল তেমন জটিল না হওয়ায় এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে এবং এর দ্বারা মোটামুটি বাস্তবের কাছাকাছি একটি ধারণা পাওয়া সম্ভব। গত কয়েক বছরের জিডিপি-বিনিয়োগের অনুপাতের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য প্রাক্কলিত আয়কর মোটামুটি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। আয়করের এ হিসাবে ২০১৪ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জনের জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন ছিল জিডিপির ৩২ শতাংশ। বাস্তবে অর্জন হয়েছিল ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ। তার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগের হার অর্জন হয়েছে মাত্র ২১ দশমিক ৪ শতাংশ, যেখানে বেসরকারি বিনিয়োগের হার ২৫ শতাংশ অর্জন হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়। উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিনিয়োগের এ হার নিতান্তই অপ্রতুল। ২০১৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৭ দশমিক ৩ শতাংশ অর্জন করতে হলে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ অর্জন করতে হবে (আয়কর ৪.৫ শতাংশ ধরে)। অর্থাত্ গত বছরের চেয়ে আরো ৪ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যা আপাতদৃষ্টিতে দুরূহ কাজ বলেই মনে হচ্ছে। উল্লেখ্য, আয়করের হার যত বেশি বিনিয়োগের গুণগত মান তত খারাপ। বাংলাদেশে বর্তমানে আয়করের যে হার (৪.৫%), তা দক্ষিণ এশিয়া এবং অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে বেশি। ফলে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বিনিয়োগের মান এবং পরিমাণ দুটোই বাড়াতে হবে।

বেসরকারি বিনিয়োগ যদি প্রবৃদ্ধি অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হয়ে থাকে, তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ কম হওয়া এবং তা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে থাকার কারণ বিশ্লেষণ করাটা অত্যন্ত প্রয়োজন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধ কেটেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। এ ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে, যার নেতিবাচক প্রভাব বিনিয়োগের ওপর পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক বা রক্ষণশীল মুদ্রানীতি, যা মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো কাজ করেছে। সংকোচনমূলক বা রক্ষণশীল মুদ্রানীতির ফলে ব্যাংকের উচ্চসুদের হার বজায় ছিল, যার প্রভাবও বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক ছিল বলে ধারণা করা যায়। এ সময়ে ২০১৩-১৪ বছরে ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১১ শতাংশ, যা বেশকিছু বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। যে সময়ে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, সেখানে বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন ছিল, যা সময়মতো করা হয়নি। ফলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন হয়নি।

বেসরকারি (দেশী ও বিদেশী) বিনিয়োগের শ্লথগতির জন্য আরো কিছু বিষয় দায়ী ছিল। উচ্চ বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত দুর্বলতা এক বড় প্রতিবন্ধকতা। বিদ্যুত্ ও গ্যাস সরবরাহের অপ্রতুলতা, বিনিয়োগের জন্য যথাযথ ভূমির অভাব, বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনে বিলম্ব এবং সর্বোপরি বিশ্বমন্দা প্রলম্বিত হওয়াটা বিনিয়োগের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে বিদ্যুত্ ও গ্যাস উত্পাদন বাড়ায় বেসরকারি বিনিয়োগ নিরুত্সাহিত হয়েছে। যদিও বিদ্যুত্ উত্পাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির হার সন্তোষজনক ছিল, প্রকৃত উত্পাদন বৃদ্ধির হার সে তুলনায় কম ছিল। ভর্তুকির পরিমাণ কম রাখার লক্ষ্যে অনেক কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের সর্বোচ্চ উত্পাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়নি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতে প্রবৃদ্ধির হার (৭.৪%) পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় (৮.৯৯%) কম ছিল। তবে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি যেসব ব্যবস্থা নেয়া যেত যেমন— স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা এবং সে লক্ষ্যে যথাযথ নীতি গ্রহণ, প্রণোদনার ব্যবস্থা করা, তার কোনোটাই করা হয়নি। সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ গত বছর লক্ষ্যমাত্রাকে কিছুটা ছাড়িয়ে গেছে, যা সন্তোষজনক। কিন্তু বিনিয়োগের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এডিপি বাস্তবায়নের ধীরগতি এবং বছরের শেষ দিকে তাড়াহুড়ো করে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টার ফলে সরকারি বিনিয়োগের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। 

২০১৩-১৪ অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্য তথা আমদানি-রফতানি প্রবৃদ্ধির হারও শ্লথ ছিল। রফতানি প্রবৃদ্ধির ১৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ হার অর্জন হয় ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যা তার আগের বছরের প্রায় সমান। বিশ্বমন্দা, দেশে বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গার্মেন্ট শিল্পে দুটি বড় দুর্ঘটনা (রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনসে দুর্ঘটনা) রফতানির প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। নতুন বছরের (২০১৪-১৫) রফতানি প্রবৃদ্ধি গত বছরের এ সময়ের চেয়েও কম দেখা যাচ্ছে এবং লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশের রফতানির ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে, তাই এ শিল্পে কমপ্লায়েন্স মান যথাযথভাবে পরিপালন এবং ক্রেতাদের আস্থা বৃদ্ধির ওপর মোট রফতানি প্রবৃদ্ধির অনেকটাই নির্ভর করবে। সামনের দিনগুলোয় রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন নতুন বাজার খোঁজার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার ওপর রফতানি প্রবৃদ্ধি বেগবান হওয়া নির্ভর করছে। বাজার খোঁজার ক্ষেত্রে ওইসব বাজারের বা দেশের স্যানিটারি এবং ফাইটো-স্যানিটারি মান সম্পর্কে অবগত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ বিষয়ে সম্যক ধারণার অভাবে অনেক বাংলাদেশী পণ্য বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অন্যদিকে দেশের সামষ্টিক চাহিদার দুর্বলতা এবং বিনিয়োগের স্থবিরতার ফলে আমদানির কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়নি। গত বছর (২০১৩-১৪) আমদানি প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে ১৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ, তার আগের বছর যা ছিল ঋণাত্মক। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি প্রবৃদ্ধি ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল ঋণাত্মক। গত বছর মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কিছুটা বাড়লেও তা মূলত টেলিযোগাযোগ খাতের থ্রিজি-সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিতে সীমাবদ্ধ ছিল। বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি, ব্যাংকের সুদের হার যৌক্তিকীকরণ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন হলে আমদানি প্রবৃদ্ধিও ঊর্ধ্বমুখী হবে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। 

গত বছর দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। প্রায় এক দশক পর গত বছর প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের (রেমিট্যান্সের) ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি কমে যাওয়া এর অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়। সৌদি আরবে আকামা হালনাগাদ করা-সংক্রান্ত জটিলতা এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি কমে যাওয়ার কারণে গত বছর রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যায় বলে অনেকে ধারণা করছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও এ সময়ে অনেকে দেশে অর্থ পাঠানো অনিরাপদ ভেবে থাকতে পারেন। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের কিছুটা ঊর্ধ্ব মূল্যায়নও (appreciation) রেমিট্যান্স প্রেরণে অনেককে নিরুত্সাহিত করে থাকতে পারে। তবে এ বছর রেমিট্যান্স প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। রেমিট্যান্সের অর্থের বেশির ভাগই জনগণ ভোগে ব্যয় করে থাকে এবং সামান্যই বিনিয়োগে যায়। রেমিট্যান্সের অর্থ আরো বেশি করে কীভাবে বিনিয়োগে নিয়োজিত করা যায়, সে বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কিছু প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। এ ধরনের বিনিয়োগকারীদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া, ট্যাক্স মওকুফ করাসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের ঘোষণা এলে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স, বাজার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার কেনা (বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ঊর্ধ্ব মূল্যায়ন ঠেকাতে), আমদানি ও রফতানি কমে যাওয়ার ফলস্বরূপ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়তে থাকে এ সময়ে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এ পরিমাণ রিজার্ভ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। বর্ধিত রিজার্ভের যেমন সুফল রয়েছে, তেমনি এর কুফলও রয়েছে অর্থনীতিতে। রিজার্ভ ভালো থাকলে তা আমদানি ব্যয় মেটানোয় সহায়ক হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার অন্যান্য সংকট মোকাবেলায় সহায়তা করে। অন্যদিকে বড় রিজার্ভ অর্থনীতির জন্য ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়ায়। বড় রিজার্ভের একটি পরিচালনা ব্যয় রয়েছে। এছাড়া বড় রিজার্ভের কারণে টাকার মূল্যমান বেড়ে মুদ্রা বিনিময় হারের ঊর্ধ্ব মূল্যায়ন ঘটে। এটি হলে বাংলাদেশের রফতানি পণ্য বিদেশে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। এছাড়া সুদের হার বাড়ারও সম্ভাবনা থেকে যায়। এ ধরনের সমস্যাকে অর্থনীতিতে ‘ডাচ ডিজিজ’ নামে অভিহিত করা হয়, যা নেদারল্যান্ডসে ১৯৬০ সালে ঘটেছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে নেদারল্যান্ডস অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হয়েছিল। এ অবস্থায় আমাদের মতো দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কত থাকা উচিত, তা নিয়ে অবশ্যই চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে।

মূল্যস্ফীতির হারের তেমন উত্থান-পতন গত বছর ঘটেনি। মূল্যস্ফীতি ৬-৮ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। তবে তা সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশিই ছিল সবসময়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকার বড় কারণ ছিল খাদ্য মূল্যস্ফীতি কম থাকা। এ সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৪-৬ শতাংশের মধ্যে ছিল। খাদ্যশস্যের ভালো ফলন, আবহাওয়া ভালো থাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়া ইত্যাদি কারণে খাদ্য সরবরাহ অবস্থা ভালো ছিল, যার ফলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এ সময়ে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি মূলত খাদ্য মূল্যস্ফীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ হয়ে থাকে বিধায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতির গতি-প্রকৃতির প্রতি অধিকতর নজর দিতে হবে। তাই মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ না হয়ে বরং তা বিনিয়োগের গতি মন্থর করে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শ্লথ করায় সহায়তা করবে। এখন বিশ্ববাজারে তেলের দামের যে নিম্নগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং দেশী খাদ্য সরবরাহ ভালো থাকায় ২০১৫ সালেও মূল্যস্ফীতি নিম্নগতির দিকে থাকবে বলে ধারণা করা যায়। তবে সরকারি পে-কমিশনের সুপারিশকৃত পে-স্কেল একবারে যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে তা মূল্যস্ফীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ধাপে ধাপে এ পে-স্কেল বাস্তবায়ন করা হলে তার প্রভাব মূল্যস্ফীতির ওপর সহনীয় হবে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির নিম্নগতি যদি বজায় থাকে, তাহলে পে-স্কেল বাস্তবায়নে সরকার কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে এবং এর প্রভাব মূল্যস্ফীতির ওপর অনেকটাই সহনীয় হবে।

আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম বিগত বছরের আলোচিত বিষয় ছিল। আর্থিক খাতে হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও অন্যান্য কেলেঙ্কারির পর গত বছর বেসিক ব্যাংকের আর্থিক অনিয়ম আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। আর্থিক খাতের এসব সংকটের ফলে স্বাভাবিক ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং তা বিনিয়োগ পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এরই জের ধরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আর্থিক খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি না কমাতে পারলে এটি একদিকে যেমন আর্থিক খাতের সংকট বাড়াবে, তেমনি তা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর্থিক খাতের এসব অনিয়ম বন্ধে ব্যর্থ হওয়ার দায়ভার বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুপারভিশনের যে আইনগত বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে, তা তারা যথাযথভাবে পরিপালনে সমর্থ হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

ব্যাংকিং খাতে পুঞ্জীভূত অলস তারল্য অর্থনীতির জন্য আরেক চিন্তার বিষয়। এক-দেড় বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে অলস তারল্য পুঞ্জীভূত হয়ে আসছে। বর্তমানে অলস তারল্যের পরিমাণ দেড় লক্ষ কোটি টাকার মতো (পত্রিকান্তরে জানা)। এই বিশাল পরিমাণ অলস তারল্যের কারণ হিসেবে বিনিয়োগের স্থবিরতা তথা অর্থনীতির সামগ্রিক চাহিদার দুর্বলতা যেমন দায়ী, তেমনি মুদ্রানীতিও অনেকাংশে দায়ী। এত বিশাল পরিমাণ তারল্য থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো সুদের হার কমানোর ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়। এছাড়া ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলাও এতে ভূমিকা রেখে চলেছে। ব্যাংকিং খাতের এ অলস তারল্য কমানোর ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারলে তা দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে এবং অর্থনীতিকে সংকটে ফেলতে পারে।

সামগ্রিক বিচারে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিগত বছরগুলোয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপর বজায় থাকা অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তিকেই নির্দেশ করে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা এবং দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা ছাড়াও নীতিগত কিছু সীমাবদ্ধতা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার আরো বেশি অর্জনের পথে অন্তরায় ছিল। সরকারি বিনিয়োগের গুণগত মান বৃদ্ধি, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বড় বড় অবকাঠামো যেমন— পদ্মা সেতু নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন রাস্তা নির্মাণ সম্পন্ন করা, বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রণোদনা প্রদান এবং ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সুসংহত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির হার আরো বাড়ানো সম্ভব। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে অর্থনীতির সূচকের লক্ষ্যমাত্রাগুলো আরো বাস্তবভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন। এবং এক্ষেত্রে যেসব মডেল (বিশেষ করে সিজিই মডেল) বা বিশ্লেষণ করা হয়, তার গুণগত মান আরো ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। পরিকল্পনা শুধু পরিকল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে— এ মানসিকতা থেকে বোধহয় বের হয়ে আসার সময় এসেছে।

লেখক: সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বিআইডিএস

Source: Bonikbarta 12.01.2015