ড. এ কে এনামুল হক

দেশে প্রতি বছর কাজে যোগ দিচ্ছে ২৭ লাখ লোক। এ ২৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি যেমন অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য। প্রশ্ন আসতে পারে, এত লোকের কর্মসংস্থান কি সম্ভব? অনেকেই ভাববেন প্রায় অসম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে তা সত্য। কর্মসংস্থান তৈরি জোর করে সম্ভব নয়। প্রয়োজন বিনিয়োগ। তাই দেখবেন অর্থনীতিবিদরা প্রায়ই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির কথা বলেন। এ বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ আসলে কী? অনেকে মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা লোপ পেলেই হয়তোবা বিনিয়োগ বাড়বে। কেউ মনে করেন, প্রশাসনিক সংস্কার করলেই হয়তোবা বিনিয়োগ বাড়বে। কারো মতে, অর্থনীতির সামষ্টিক কাঠামোয় ভারসাম্য থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে। সব কথাই কিছুটা সত্য। তবে আমার মতে, আমরা সবাই কেন যেন বিনিয়োগকারীর মনস্তাত্ত্ব্বিক বিশ্লেষণ না করেই কথাগুলো বলছি। বিষয়টি খোলাসা করতেই আজকের লেখা।

২০১১ সালের কথা। কথা হচ্ছিল বোস্টনের অর্থনীতির অধ্যাপক গুস্তব পাপানেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ইন্দোনেশিয়ায় তিনি এক পশ্চিমা বিনিয়োগকারীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন তিনি ভারত বাদ দিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় তার চীনা বিনিয়োগ স্থানান্তর করলেন। এ প্রশ্ন করার কারণ ছিল, তখনকার সময়ে ভারতে শ্রমিকের মজুরি ইন্দোনেশিয়ার অর্ধেক। তাই তার জানার ইচ্ছে ছিল কেন ভারতে নয়? বিনিয়োগকারী তাকে চমত্কার উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভারতের রাজনীতিবিদদের কালচার বিনিয়োগবান্ধব নয়। ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে বললে বিনিয়োগকারী জানান, যে কোনো বিনিয়োগের প্রথম চার পাঁচ বছর সাধারণত মুনাফা থাকে না। এ সময়ে কারখানা স্থাপনসহ নানা বিষয়ে খরচ হতেই থাকে। তবে পরবর্তীতে মুনাফা হয়। মূলত বিনিয়োগকারী এ মুনাফার ভরসায়ই বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। তার বিশ্লেষণে তিনি দেখেছেন যে, ভারতে বিনিয়োগ করলে এ প্রথম চার পাঁচ বছরই শান্তিতে থাকা যায়। কোনো ধরনের ঝুটঝামেলা কিংবা শ্রম অসন্তোষ থাকে না। তবে গণ্ডগোল লাগে মুনাফা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। প্রথমে শ্রমিক জোট একতাবদ্ধ হয় মজুরির অস্বাভাবিক বৃদ্ধির দাবিতে। অতঃপর রাজনীতিবিদরা শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে শুরু করেন যুগপত্ আন্দোলন। এ অবস্থায় সস্তায় শ্রমিক পাওয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগ পর্যাপ্ত মুনাফা লাভের সুযোগ পায় না। বিনিয়োগের ঝুঁকি ভারতে বেশি। তাই তিনি ইন্দোনেশিয়ায় মজুরি দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও বিনিয়োগ করেছে। ভাবুন দেখি, কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন এক্ষেত্রে?

২০০৭ বা ২০০৮ সালের আরেকটি ঘটনা বলি। কলকাতা থেকে ঢাকায় আসছি। বিমানে আমার পাশে বসেছিলেন এক ভারতীয় ব্যবসায়ী। চেন্নাই ও কলকাতায় তার ব্যবসা রয়েছে। তিনি বিনিয়োগের ইচ্ছা থেকেই কয়েকবার ঢাকায় এসেছেন। পরিচয় জানার পর বললেন, তার এখন আর খুব একটা ইচ্ছে নেই ঢাকায় বিনিয়োগ করার। জিজ্ঞেস করলাম কেন? উত্তরে বললেন, এতবার আসার পরও বুঝতে পারছেন না, কী করলে কী হবে এ দেশে। যত ধরনের দালাল তিনি পেয়েছেন, তাদের সবাই বলেছেন, তারা চোখের পলকে সব কাজ করে দেবেন। কিন্তু এত দিনে তিনি বুঝতে পেরেছেন, এখানে কী দিয়ে কী হয়, তা কারো কাছে স্পষ্ট নয়। ফলে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাসহ যতজন তার কাছে এসেছেন সবাই বলেছেন, বিনিয়োগের অনুমতি পাওয়া নাকি সহজ ব্যাপার। টাকা দিলেই হয়। তার ধারণা এখানে আইন-কানুন সুস্পষ্ট নয়। তাই কেউ জানে না কোথা থেকে ঝামেলা আসতে পারে। ফলে কাজ শেষ হয়েও শেষ হয় না। বুঝতেই পারছেন সংস্কার প্রয়োজন। কোথায়? আইনে, নাকি আইনের প্রয়োগে? নাকি প্রতিষ্ঠানে? নাকি যারা এসব অনুমতি দিয়ে থাকেন?

আমাদের প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ অত্যন্ত প্রয়োজন। কী ধরনের বিনিয়োগ? যে বিনিয়োগে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি প্রকাশিত ইপিজেডের তথ্য অনুযায়ী প্রতি ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ বা প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে ইপিজেডে একজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়। তাই বিনিয়োগ বাড়াতে আমাদের আগ্রহের কমতি নেই। এরই মধ্যে আমি নিজেই লিখেছি— বিনিয়োগবান্ধব অর্থনীতি চাই। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী দুজনেই বলেছেন, বিনিয়োগ বৃদ্ধি আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত জরুরি। অধুনা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণাপত্রেও বিনিয়োগ বৃদ্ধির কয়েকটি চাবিকাঠি আবিষ্কৃত হয়েছে। আমাদের বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সংস্কার।

তাই বলা চলে ‘সংস্কার’ কী, তা জানাটাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। বিষয়গুলো কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করি। বাংলাদেশ মধ্যম আকারের দেশ। পৃথিবীর মানচিত্রে এ দেশ আয়তনে ৮২তম। জনসংখ্যায় নবম। প্রতি বছর আমাদের কৃষিজমি কমছে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর। এ দেশ সত্তরের দশকে ছিল পাট ও চা রফতানির দেশ। আশির দশকে যোগ হয়েছিল গার্মেন্টস ও চিংড়ি। নব্বইয়ের দশকে আমরা গার্মেন্টসে কিছুটা নতুনত্ব এনেছি, যোগ করেছি নিটওয়্যারকে। বর্তমানে আমরা চা আমদানি করি; মাছ আমদানি করি; আমদানি করি ফলমূল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর কৃষিজমির সংকোচন মিলে আমাদের রফতানি পণ্যের ভাণ্ডারে কৃষিজাত পণ্য ভবিষ্যতে থাকবে বলে মনে হয় না। তাই আমাদের বিনিয়োগ প্রয়োজন শিল্প খাতে। একমাত্র শিল্প খাতে বিনিয়োগই পারে আমাদের বিপুলসংখ্যক অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষ শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে। তবে গার্মেন্ট শিল্পের বিশৃঙ্খলা অনেক বিনিয়োগকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে। আমাদের সংস্কারের শুরু করতে হবে এখান থেকেই।

শ্রমিক অসন্তোষ বন্ধ হবে— এ ধারণা ভুল। শ্রমিক অসন্তোষের কারণ চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে সচেষ্ট হতে হবে। বুঝতে হবে বিদ্যমান ব্যবস্থায় শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির যথেষ্ট কারণ আছে। তাই শ্রমিক অসন্তোষ হলে কে করছে, দেশদ্রোহী, বিদেশী ইন্ধন— এ জাতীয় অজুহাত তৈরি করে শ্রমিক অসন্তোষকে দমন করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। এতে শ্রমিক অসন্তোষ আপাতত কমলেও যত দিন পর্যন্ত এর সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘকালীন সমাধানের স্বার্থে সংস্কার কার্যক্রম না চালানো হবে, তত দিন পর্যন্ত নামকাওয়াস্তে সংস্কার দেশী বা বিদেশী কোনো বিনিয়োগকারীকেই আগ্রহী করবে না। অনেকে ভাবছেন, কেবল বেতন বাড়ালেই হয়তো এ অসন্তোষ কমবে। আমি তা মনে করি না। টিফিন খারাপ, পরিবেশ খারাপ, ছোটখাটো দুর্ঘটনা, যা যে কোনো শিল্পে সর্বদাই ঘটে; তাতেই অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করবে। হরহামেশাই তা হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন, এ বিষয়ে শ্রমিক-মালিকের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন মালিক-শ্রমিক বন্ধন তৈরি করা। বিষয়টি নিয়ে ভেবেচিন্তে সংস্কার করা প্রয়োজন। কেবল শ্রমিক ইউনিয়ন তৈরি করলেই তা হবে বলে আমার মনে হয় না। অকার্যকর শ্রম মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করারও প্রয়োজন আছে।

অবশ্য আমার আজকের আলোচনার মুখ্য বিষয় অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিক নিয়ে নয়— অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিক কখনো বেকার থাকেন না। তাদের পক্ষে বেশি দিন বেকার থাকা সম্ভব নয়। তাই তারা চাকরি হারানোমাত্রই অন্যত্র কাজ জোগাড় করে ফেলেন। কাজ তারা সহজে পান। শ্রম পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশের উপরে ওঠার পর থেকে দেশে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিকের নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। এর প্রায় সবটুকুই বেসরকারি খাতে। আমাদের প্রয়োজন দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। সংস্কার প্রয়োজন এখানে। অথচ এ বিষয়ে তেমন কোনো চিন্তাভাবনা হচ্ছে না। প্রশ্ন হতে পারে, কী করে দক্ষ লোকের কর্মসংস্থান করা যায়?

দক্ষ বা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের মাধ্যম প্রধানত দু-একটি মাঝারি বা ভারী শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি অথবা সেবা খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্ম সৃষ্টি। কী করে আমরা এ খাতকে আরো গতিশীল করতে পারি, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। যদি তা না করা যায়, তবে আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। অর্থনৈতিকভাবে আমরা ভবিষতে পঙ্গু অর্থনীতিতে পরিণত হব। কেন? কারণ খুবই সহজ। ১৮-২০ লাখ ছাত্রছাত্রী প্রতি বছর অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রায় ৮ লাখ ঝরে পড়ছে। ১১-১৪ লাখ এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। ২-৩ লাখ ঝরে পড়ছে। ১০-১১ লাখ এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে অথচ এর মাত্র ২-৩ লাখ কোথাও ভর্তি হতে পারছে। বাকিরা কলেজে ছাত্রের খাতায় নাম লিখে রাখছে কাজ না পেয়ে। এ অবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়।

দক্ষ শ্রমিকগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির আরেকটি উপায় হলো, বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা তৈরি করা। তবে এ প্রচেষ্টা ক্ষণস্থায়ী। কারণ দক্ষ শ্রমিক ক্রমে অন্যত্র স্থায়ীভাবে অভিবাসনে আগ্রহী হন অথবা তাদের দায় পরিবারের প্রতি কম হয়। তাই তারা তুলনামূলকভাবে নির্দিষ্ট সময় পর কম অর্থ পাঠান। তবে স্বল্পমেয়াদে তারা মাথাপিছু বেশি অর্থ দেশে পাঠান। এটাই আমাদের স্বল্পকালীন লাভ।

দক্ষ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য আমাদের বর্তমান বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তাভাবনা ও সংস্কার করা উচিত। পাঁচ বছর ধরে ভারত একটি নতুন সেবা রফতানি করছে। তা হলো টিউটর রফতানি। অর্থাত্ ভারতের শিক্ষক বা টিউটররা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে ভারতে বসে সেবা প্রদান করে আসছে। বিশ্বে এ টিউটর সেবার বাজার ১২-১৬ বিলিয়ন ডলার। এর মাধ্যমে ভারতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া ভারতের বহু আইনবিদ এখন বিশ্বের বিভিন্ন ল’ফার্মে অনলাইনে চাকরি করছেন। ব্যবস্থাটি সম্ভব হয়েছে পে-পাল, ভিসা কার্ডের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা সহজতর করার কারণে। আমাদের দেশের প্রায় ১ লাখ যুবক অনলাইনে কাজ করে। তারা অর্থ সংগ্রহে তৃতীয় দেশ ব্যবহার করে। আমরা কি পারি না ভারতের ব্যবস্থাটির অবিকল কপি করতে? ‘অবিকল কপি’ বললাম এজন্য যে, বিষয়টি নিয়ে আমি যত জায়গায়ই কথা বলেছি, তারা একটা কথাই বলেছেন, মানি লন্ডারিং আইনে বাধা আছে। বাধা সৃষ্টির জন্য আমরা যত সব আইন করি, সুযোগ সৃষ্টির জন্য তত নয়। তাই বললাম ভারত যখন মানি লন্ডারিং আইনের বাধা কাটিয়ে এটুকু করেছে, তখন তাদের অবিকল কপি করা ছাড়া আর কোনো উপদেশ দেয়ার মতন নেই।

ইদানীং ব্যবসা শিক্ষার প্রসার ঘটেছে ব্যাপকভাবে। এর অর্থ ব্যবসা শিক্ষায় দক্ষতা আমাদের বেশ বেড়েছে। ব্যবসা শিক্ষার একটি প্রধান অংশ হলো অ্যাকাউন্টেন্সি। কিছুদিন আগে লক্ষ করলাম একটি বিদেশী কোম্পানি অনলাইনে অ্যাকাউন্টেন্ট সেবা দিচ্ছে। ব্যাপারটি এ রকম— যে কোনো কোম্পানির সব অ্যাকাউন্টেন্সি এ কোম্পানি দিচ্ছে। কোম্পানির যে কোনো খরচের ভাউচার স্মার্টফোনের মাধ্যমে যে কোনো সময় নির্দিষ্ট স্থানে আপলোড করলেই তারা তাদের দক্ষ অ্যাকাউন্টেন্ট দ্বারা প্রয়োজনীয় লেজার, ব্যালেন্সশিট করে দিচ্ছে। ফলে কোম্পানির খরচ অনেক কমে যায়। বুঝতেই পারছেন, ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচুর সেবা এখন ঘরে বসে দেয়া বা নেয়া যায়। অথচ দেশে সেই সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। নিয়ম-কানুনের ফাঁকে সব চাপা পড়ে যাচ্ছে। আমরা এখনো ভাবছি ডাটা এন্ট্রি শিল্প নিয়ে! সেলুকাস! অনলাইন সেবা যেখানে ঘরে বসে দেয়া যায়, সেখানে আমাদের প্রচেষ্টা বিশাল জায়গায় আইটিপার্ক তৈরি করা, অবাস্তব পরিকল্পনা।

ঢাকায় ইদানীং অনেকেই রয়েছেন, যারা প্রকৃত অর্থেই নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকেন। নিয়তির কারণে তারা হয় একা বা বৃদ্ধ অবস্থায় একা কিংবা বৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রী একটি বাসায় অবস্থান করছেন। তাদের ছেলেমেয়ে থাকে বিদেশে। তারা নিয়মিত অর্থ পাঠায় বা পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু তাদের নিত্যদিনের বাজার-সদাই অনেকেই বিদেশ থেকে পাঠাতে পারত, যদি ইন্টারনেটভিত্তিক গ্রোসারির শপের প্রসার ঘটে। শুরু হয়েছে, তবে বিদেশ থেকে অর্থ আসার ক্ষেত্রে রয়েছে নিয়মকানুন। অর্থ যখন ভিসা কার্ডে আসে, যখন সুইফট দ্বারা আসে, তখন কাগুজে ফর্মের কেন প্রয়োজন? জিজ্ঞেস করেছিলাম এক পরিচিত ব্যাংক ব্যবস্থাপককে। উত্তর একই, মানি লন্ডারিং আইন। সব জায়গায় জুজুর ভয়। যেন পৃথিবীর অন্য কোথাও এ আইন নেই! তাহলে তারা এত ব্যবসা করে কীভাবে? কীভাবে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়?

ঢাকার এক ফার্ম সারা পৃথিবীতে ব্যবসা করতে আগ্রহী। কী রকম ব্যবসা? ধরুন, আর্কিটেক্ট কিংবা কোনো কনসালটেন্সি ফার্ম। তার প্রয়োজন বিভিন্ন দেশে যাওয়া, কন্ট্রাক্ট জোগাড় করা এবং সেই অনুযায়ী লেনদেন করা। সম্ভব কি? না সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নিয়ম আছে, কিন্তু ব্যাংক বলছে নিয়ম জানে না। কারো পক্ষে সম্ভব এ দুমুখো সাপকে বশ করা? নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি, বই কিনতে চাইলাম, ক্রেডিট কার্ডে সম্ভব হলো না। বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করলাম। সর্বশেষ উত্তর পেলাম আমাদের ‘সিস্টেম’ এখনো রেডি না। তাই এখন সম্ভব নয়, তবে আপনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় সম্ভব। আমাদের ২৪ ঘণ্টা আগে জানাবেন! হায় বাংলাদেশ! প্রত্যেক নাগরিকের জন্য এখন বিশেষ ব্যবস্থা লাগবে! সেবামূলক ব্যবসা প্রসারের প্রধান নিয়ামক হলো সহজ ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এ দেশে কি সম্ভব? সে সংস্কার কি আমরা করছি?

আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার কী করে সম্ভব হয়েছিল? হয়েছিল তত্কালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও তার পরিষদের প্রণীত কয়েকটি আইনের কারণে। ওই পরিষদে বর্তমান অর্থমন্ত্রীও ছিলেন। তখন বয়স কম ছিল বলেই সম্ভবত বৈপ্লবিক চিন্তা করেছিলেন! তারা এ শিল্পকে প্রসারিত করতে আয়কর আইনে পরিবর্তন এনেছিলেন, ব্যাংক ফিন্যান্স তৈরি করতে আইবিপির প্রবর্তন করেছিলেন, এমনকি ব্যাংকের ওয়ারহাউস রুলে পরিবর্তন এনেছিলেন। তাই সম্ভবত বাংলাদেশ উত্তরকালের সব সংস্কারের এটি এক উত্কৃষ্ট উদাহরণ। এর ফলে গড়ে উঠেছে আমাদের গার্মেন্ট শিল্প।

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে আরো দুটি উপাদানের কথা বলা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত. শিল্প বা সেবা খাতে বিনিয়োগ তখনই হবে, যখন উত্পাদিত পণ্য বা সেবার বাজার সুরক্ষিত হবে। বাজার ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সুরক্ষা না হলে বিনিয়োগ হবে না। অর্থাত্ পরিবেশ রয়েছে, আইনের পরিবর্তন হয়েছে, তার পরও বিনিয়োগ হবে না বাজারে পণ্যের বা সেবার চাহিদা না থাকলে। এক্ষেত্রেও আমাদের গার্মেন্ট একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পৃথিবীর কোথাও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্র্যান্ড হিসেবে আমাদের গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়নি অথচ আমরা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ। এটি সম্ভব হয়েছে বায়িং হাউসগুলোর মাধ্যমে। পৃথিবীর প্রায় সব খুচরা বিক্রেতা বাংলাদেশে তাদের পোশাক তৈরির অর্ডার দেয়। অর্থাত্ বায়িং হাউসগুলো আমাদের উত্পাদনকারীর সঙ্গে বিদেশের বাজারের যোগসূত্র তৈরি করে দিয়েছে।

সেবা খাতেও এ একই ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। এটা ধারণা করা ঠিক হবে না যে, আমাদের কনসালটেন্সি ফার্মের বা অ্যাকাউন্টেন্ট ফার্মের বা ল’ ফার্মের দ্বারা পৃথিবীর বিশাল সেবার বাজারে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে। আমাদের প্রয়োজন সুচিন্তিতভাবে কিছু সংস্কার করা, যাতে পৃথিবীর সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যথা অ্যাকাউন্টেনসি ফার্ম, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, প্রকৌশলী ও স্থপতি সংস্থা, ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাসেবা প্রতিষ্ঠান, ল’ ফার্ম, ব্যাংকসহ সবাই বাংলাদেশকে তাদের একটি ব্যবসাকেন্দ্র বলে চিন্তা করতে পারে। এখান থেকেই তার গোটা এশিয়ায় তাদের সেবা দেবে।

অধুনা এশিয়াকে কেন্দ্র করে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান এশিয়ায় তাদের ব্যবসাকেন্দ্র স্থানান্তর করতে চাচ্ছে। বাংলাদেশ সার্কের একটি প্রতিষ্ঠাতা দেশ, বাংলাদেশ বিমসটেকের কেন্দ্রবিন্দু, বাংলাদেশ বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোক্তাদের একজন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এক অপার সম্ভাবনার দিকে এগোচ্ছে। এ অঞ্চলে অন্য দেশের চেয়ে এশিয়াজুড়ে সেবা খাতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করা অসম্ভব কিছু নয়।

প্রশ্ন আসে কী করে সম্ভব? কিসের সংস্কার করতে হবে? প্রয়োজন বৈপ্লবিক চিন্তার। কিছুদিন আগে একটি বিদেশী কোম্পানি আমার সঙ্গে কথা বলছিল। ভদ্রলোক ভারতীয় বংশোদ্ভূদ, তবে সিঙ্গাপুরের নাগরিক আর তার ব্যবসা মালয়েশিয়ায়। তিনি কুয়ালালামপুরেই ব্যবসা করেন, সিঙ্গাপুরে নয়। কারণ তাতে ব্যয় সাশ্রয় হয়। আলোচনার শেষের দিকে তার ভিজিটিং কার্ডে নজর দিতেই একটু অবাক হলাম। ঠিকানায় মালয়েশিয়ার বাইরেও আরেকটি ঠিকানা। তাতে লেখা ছিল ‘ইউএস ভার্জিন আইল্যান্ড’! কী ব্যাপার? বুঝতেই পারলাম কর ফাঁকির কৌশল। কিন্তু মালয়েশিয়া তার দেশে কোম্পানিকে কাজ করতে দিতে রাজি। কারণ তারা কুয়ালালামপুরে থাকলে সেবা খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এটাই লাভ। একই নিয়ম ইউকে, ইউএসএ-সহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশে চালু আছে। সবাই জানে, করভার কমাতে এসব কোম্পানি ব্যবসার নিবন্ধন সেই দেশেই করছে, যেখানে সুবিধা রয়েছে। এ কৌশল বন্ধ করা অসম্ভব। তাই তা মেনে নিয়েই প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার করেছে দেশগুলো, যাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। আমরা তো মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। তাহলে আমাদের কি উচিত নয়, সেসব দেশের আর্থিক আইন অনুসরণ করা, যেখানে সেবা খাতে বিস্তর প্রসার ঘটেছে?

সেবা খাতে প্রসার ঘটানোর দ্বিতীয় কৌশল হলো, দেশের সঙ্গে বিদেশের যোগাযোগ সস্তা ও সহজ করা। এর জন্য প্রয়োজন ঢাকাকে বিমান ভ্রমণের কেন্দ্রে বা হাবে পরিণত করা। যে দেশই বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক হাব বা কেন্দ্রে রূপান্তর করেছে, সে দেশেই সেবামূলক খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে। আমাদের সেই সুযোগ কি আছে? বাংলাদেশ বিমানকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। এর জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা সরকারের পক্ষে জোগান দেয়া সম্ভব হলেও অনুচিত। বর্তমানে এশিয়া মহাদেশে বিমান ভ্রমণের ব্যাপক বিস্তার ঘটছে। এ বাজার দখলে নিতে চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত কেউই ছাড় দিচ্ছে না। সবাই চায় বাজার দখলে রাখতে। এতে মার খাচ্ছে ইউরোপীয় এয়ারলাইনসগুলো। ইউরোপীয় সব এয়ারলাইনসই চায় এশিয়ায় একটি নিজস্ব হাব বা ব্যবসাকেন্দ্র। আমার মতে, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে এসব এয়ারলাইনসের একটিকে ঢাকা বিমানবন্দরকে তাদের এশীয় হাব হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া যায়। এক্ষেত্রে তারা নিজেরাই এখানে বিনিয়োগ করবে। আমাদের তেমন কোনো বিনিয়োগ করতে হবে না, বরং আমাদের আয় বাড়বে বিনা বিনিয়োগে। তার সঙ্গে ঢাকা হবে ইউরোপের এশীয় বিমানকেন্দ্র। লাভ হবে সবার। সিভিল এভিয়েশন পাবে বাড়তি আয়। ঢাকায় বিমান যাতায়াতের খরচ কমবে (কারণ যে কোনো হাবে বিমান ভাড়া সবসময় নন-হাব বিমানবন্দরের তুলনায় কম হয়)। আমাদের দেশে বিদেশী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সহজে ও সস্তায় যাতায়াতের সুযোগ পাবে। বিনিয়োগ বাড়বে সেবা খাতে। দেশেই কর্মসংস্থান বাড়বে দক্ষ জনগোষ্ঠীর। অন্যদিকে কৃষিপণ্য তথা শাকসবজি, গার্মেন্ট পণ্য আমদানি-রফতানি করার সুযোগ হবে অবারিত। কারণ যে কোনো হাবে বিমান পরিবহন খরচ কম হয়। বিনা পয়সায় এমন সুযোগ আগামীতে আর আসবে না। কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই কিছু মৌলিক ও দিগন্ত উন্মোচনকারী সংস্কার দ্বারা এ ধরনের সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভব।

সবশেষে আগামী দুই দশকে এশীয় অঞ্চল পরিবর্তিত হবে। বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে এ পরিবর্তনের সুযোগ গ্রহণ করবে। আমাদের দৃষ্টি এখনো অতীতের দিকে। অতীতে যেভাবে এ দেশ চলেছে, ভবিষ্যতে সেভাবে চলবে না। নতুন প্রজন্ম তা গ্রহণ করবে না। অতীতের যে ছাত্র বেকার হয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছিল, বর্তমানের বেকার কিন্তু ‘কিছু একটা’য় রাজি হবে না। তার চাহিদা অনেক। তাই শিক্ষিত বেকারের চাকরি সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের এখনই চিন্তা করা উচিত।

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট

Source: bonikbarta, 29.09.2014