ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৬১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ। রাজস্ব পাওয়ার ক্ষেত্র ধরা হয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত এক লাখ ৫৫ হাজার ২৯২ কোটি এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে এক লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকার কর রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে। এনবিআরবহির্ভূত সূত্র থেকে রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। এ ছাড়া করবহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরণ হবে ২৭ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেটে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ২৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা ও অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে ৪৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সংগ্রহ করা হবে ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ১২ হাজার ৫৬ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অনুন্নয়ন বাজেটে ১৭ শতাংশ ব্যয় হবে শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়। অপ্রত্যাশিত ব্যয় ও অন্যান্য থোকের জন্য ব্যয় হবে ১ দশমিক ২ শতাংশ। ভর্তুকি ও প্রণোদনার ক্ষেত্রে ব্যয় হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। পেনশন বাবদ ব্যয় হবে ৫ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হবে সুদে, যার পরিমাণ প্রায় ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। অনুন্নয়ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কল্যাণে ব্যয় হবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। জনপ্রশাসনে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। কৃষিতে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ব্যয় হবে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে, যার পরিমাণ ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এদিকে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন বাজেটে সম্পদের ব্যবহার হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হবে জনপ্রশাসন খাতে। এ খাতে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় হবে। এর পরই রয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি, যার পরিমাণ ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। সুদ খাতে ব্যয় হবে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হবে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। কৃষিতে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ৪ দশমিক ৪, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
ব্যক্তি খাতে করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত থাকছে। তবে বয়স্ক মহিলা, প্রতিবন্ধী, নিবন্ধিত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবার আয়কর ফাঁকি দেয়া বন্ধ করতে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়িভাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধের বিধান করা হচ্ছে। এ ছাড়া যাদের আয় বছরে ৪৪ লাখ ২০ হাজার টাকা তাদের ৩০ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে উপকারভোগীর সংখ্যা একদিকে যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ভাতার হার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে করপোরেট ট্যাক্স বাড়ছে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরিবর্তিত থাকছে। কর অবকাশের মেয়াদ বাড়ছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে যারা শিল্পায়নে উদ্যোগ নেবেন তাদের জন্য বিশেষ রেয়াত দেয়া হবে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার আভাস দিয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারের জন্য দুটি সুবিধা প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিমিউচুয়ালাইজড স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকে ক্রমহ্রাসমান হারে পাঁচ বছরের জন্য কর অব্যাহতি সুবিধা দেয়া এবং করমুক্ত লভ্যাংশ আয়সীমা ১০ হাজার থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বাড়ানো হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের আওতা। একই সঙ্গে করের হার বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করতে দেয়া হয়েছে কর ছাড়। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ২৮ হাজার ১৫ কোটি টাকা বেশি। ঘাটতি হবে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রায় আট হাজার কোটি টাকা বেশি। এ বাজেট উচ্চাভিলাষী হিসেবে প্রতিভাত হলেও এখানে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা যৌক্তিক হতে হলে বাস্তবায়নে পারদর্শিতা দেখাতে হবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার অর্জন নিয়ে সাম্প্রতিককালের অভিজ্ঞতার আলোকে, বিশেষ করে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের অস্বস্তিকর অবস্থার কারণে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। বাজেটে সম্পদশালীর কাছ থেকে কর আদায় করার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে দেশের রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতির আলোকে এ ইতিবাচকতা অর্থবহ না হয়ে নেতিবাচক হয়ে যাতে না ওঠে এর জন্য যথেষ্ট কৌশলী, দক্ষতা ও সুশাসনে যতœবান হতে হবে কর বিভাগকে। স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে চিরাচরিতভাবে। এটা বাস্তবায়নে কৌশল নির্ধারণ ও পদক্ষেপ প্রক্ষেপণে কোনো নির্দেশনা নেই। বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা কীভাবে সম্ভব হবে, তাও দেখার বিষয়।
২০১৪-১৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটটি বেশ কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও বিবেচনার নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ। প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার স্বাভাবিক ধারাতেই এটি প্রণীত হয়েছে। কিন্তু এর আকার নিয়ে যেমন সমস্যা অনুভূত হচ্ছে, তেমনি এর বাস্তবায়ন উপযোগিতা নিয়েও। কেননা এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে ১. রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি, ২. বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব ও ৩. বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা প্রশাসনিক নেতৃত্বের দৃঢ়চিত্ততা ও দক্ষতার প্রশ্ন। দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের প্রেক্ষাপটে এটা নিত্যনিয়তিতে আপতিত হচ্ছে ১.  নির্বাচনকে ঘিরে নানা প্রশ্ন ও আশঙ্কার আবর্তে পড়া, ২. উন্নয়ন অভিপ্সায় ধারাবাহিকতা রক্ষা ক্রমেই কঠিন, ৩. পরস্পর দোষারোপের মধ্যে নানা দুর্বিপাক (দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন) গেড়ে বসছে সমাজ ও অর্থনীতিতে। এ নিরিখেই ধরে নিতে হচ্ছে বিগত বছরটি থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা এভাবে-সেভাবে-যেভাবেই হোক, আসন্ন অর্থবছরেও বলবৎ থাকার আশঙ্কা বাড়বে। টানাপড়েন পড়বে চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি ও পরিবহন প্রক্রিয়ায়। হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে বিনিয়োগের পরিবেশ বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এসবই আশঙ্কার কথা, যদিও নিকট অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় এমনটি হচ্ছে। উন্নয়ন অভিমুখী ও ‘টেক অফ’ করতে যাওয়া একটি অর্থনীতির জন্য টালমাটাল এ পরিস্থিতি সত্যই বিপজ্জনক ও বিব্রতকর। সুতরাং যে অর্থনীতির সমৃদ্ধি সাধনের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব অতিশয় আগ্রহী ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তাদের এক নম্বর দায়িত্ব হবে রাজনীতিসৃষ্ট রোগশোকের বালাই থেকে অর্থনীতিকে রেহাই দেয়া। সব পক্ষ যদি এ বিষয়টি নিয়ে সর্বাগ্রে সুচিন্তার দ্বারস্থ হয় তাহলে অন্যান্য সমস্যার ৮০ শতাংশ সমাধান করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশের মতো ১. মহার্ঘ বিদেশি মুদ্রা প্রত্যাবসননির্ভর, ২. বিদেশি সাহায্য ও বিনিয়োগপ্রত্যাশী, ৩. বহিঃঅর্থনীতির ওপর অন্যতম নির্ভরশীল (আমদানি-রফতানি সূত্রে) দেশের অর্থনীতি বহিরঙ্গের প্রভাবকে কোনোমতেই উপেক্ষা করতে পারে না। সুতরাং ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বৈশ্বিক পরিস্থিতির নেপথ্য প্রেরণা ও বাধা বিবেচনায় আসবেই।
প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে ও গতিতে চলে। তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলতে পারে, তবে তা প্রাকৃতিক নিয়মেই ব্যর্থ হতে পারে। ৭ দশমিক ৩ প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা অমূলক নয়। মধ্যম আয়ের দেশের টিকিট পেতে হলে প্রবৃদ্ধির বার্ষিক মাত্রা ন্যূনতম  ৭-৮-৯-এর মধ্যে হওয়ার বিকল্প নেই। ভালো কথা, উচ্চাশার প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা তাই ধরতে হবে। তবে একই সঙ্গে সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উপায়, সুযোগ ও অনুষঙ্গ-অনুরঙ্গ কোন পর্যায়ে আছে তা দেখা দরকার বৈকি। প্রবৃদ্ধি ঘটার অন্যতম উপায় অর্থনীতির চলৎশক্তির প্রাগ্রসরতা, বোধগম্যতা ও সহন ক্ষমতা। বিনিয়োগে অর্থনীতিতে সম্পদ সৃষ্টি হয়, কর্ম সৃজন হয়। কর্ম সৃজিত হলে অন্যান্য আর্থিক কর্মকা-ের প্রসার ঘটে। এতে সেখান থেকে জীবন মানের উন্নয়ন যেমন ঘটে, তেমনি রাজস্ব আয়ের সংস্থান হয়। এ রাজস্ব আবার পুনঃবিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে। সুতরাং বিনিয়োগ হওয়ার জন্য পুঁজি ও পরিবেশ প্রয়োজন। সেটি নিশ্চিত হতে হবে। মোদ্দাকথা বিনিয়োগ-প্রবৃদ্ধি-বিনিয়োগ একটি সাইকেল। প্রবৃদ্ধি হবে না যদি বিনিয়োগ না হয় আবার বিনিয়োগ হবে না প্রবৃদ্ধি না হলে। ডিম আগে না মুরগি আগের মতো অবস্থা আর কি। দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার ব্যয়ের বাজেট, যা জিডিপির ১৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। ঘাটতি জিডিপির ৫-এর মধ্যে রাখতে গেলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আয়ের হিস্যা বাড়বেই, বাড়াতে হবেই। বিশাল রাজস্ব আহরণের প্রাক্কলন সে নিরিখেই করতে হয়েছে। সেটিকে অর্জনযোগ্য করতে হলে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা, পরিবেশ, ক্লেশ, প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয় প্রয়োজন। ঘাটতির অর্থ সংগ্রহ করা হবে Ñ বিদেশি অনুদান ও ঋণ আর দেশীয় ঋণ নিয়ে। সে ক্ষেত্রেও পরিবেশ ও সুযোগ কেমন সেটা দেখা দরকার। নিকট অতীতের অভিজ্ঞতার পরিসংখ্যানের পাঁজিপুঁথি ঘেঁটে যা দেখা যায় সেখানে শঙ্কা আর আশঙ্কারা গলাগলি ধরে বসে আছে। এমতাবস্থায় ঘাটতির ঘোড়া দুর্বিনীত হবেই। তাকে থামাতে ব্যাংকঋণের দ্বারস্থ হতেই হবে। ব্যাংকগুলো চলে গ্রাহকের বিশ্বস্ততার বিনিয়োগে।
কার্যকর মুনাফায় বেসরকারি খাতকে ঋণ দেয়ার তহবিলে যদি পড়ে টানাটানি তাহলে ব্যাংকের মুনাফা করা তো দূরের কথা, তার টিকে থাকার মতো মুনাফা মিলবে কোত্থেকে? আর রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস করপোরেট ট্যাক্সপেয়ারদের শিরোমণি খোদ ব্যাংকের যদি আয় সংকুচিত হয় তাহলে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জিত হবে? তার চেয়ে বড় কথা, ব্যাংকের ঋণ দেয়ার মতো তহবিল সংকটের এ পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতের ব্যাংক থেকে পুঁজি পাওয়ার ক্ষেত্র ও সুযোগ সংকুচিত হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হবে (যা এখন ১৮ থেকে ১৯-এর মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে, যা হওয়া উচিত হবে ২৩ থেকে ২৪) বাধাগ্রস্ত। আর সরকারি বিনিয়োগ যেভাবে ৭ থেকে ৮-এর মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে তারও পরিমাণ বাড়া উচিত। বাড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করা হচ্ছে, কিন্তু উপায়ের অস্পষ্টতা কাটছে না। নিজস্ব সম্পদের দ্বারা সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে যেমন ডাবল লাভ, তেমনি সরকারি বিনিয়োগ ব্যাংক লোন দিয়ে হলে ডাবল ক্ষতি। অর্থনীতিকে ভবিষ্যতে আরো ঋণগ্রস্ত করা বা দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিমুখী করার অন্যতম অনাকাক্সিক্ষত উপায় হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করা। বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলে রাজস্ব আয় কমে যাবে। ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফায় ঘাটতি ঘটলে রাজস্ব কমে যাবে। ফলাফল যে লাউ সেই কদু। সুতরাং সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে; চড়া ও কড়া সুদের ঋণের অর্থে নয়, নিজস্ব সম্পদসৃজনকারী উপায় হিসেবে। এ নিরিখে প্রকল্প নিতে হবে সম্পদসৃজনকারী ও উপযোগিতার বাছবিচারে; যে কোনো ধরনের অনুৎপাদনশীল খাত ও গুণগত মান যাচাইযোগ্য হবে না বা নিশ্চিত হবে না এমন প্রকল্প গ্রহণ পরিহার করে। ভিন্ন উদ্দেশ্য অভিমুখী ভাব-বিলাস ব্যবস্থার বালুচর থেকে বাস্তবতার শক্ত মাটিতে পা রাখতেই এডিপির প্রকল্প বাছাই ও অর্থ বিতরণ-ব্যবস্থায় অগৌণে যথাদৃষ্টি দেয়া অতীব জরুরি।
বাজেটকে শুধু আয়-ব্যয়ের দলিল বিবেচনার সুযোগ নেই। বাজেটে যে কর্মপরিকল্পনা উচ্চারিত হবে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিক প্রয়াসের রোডম্যাপও প্রয়োজন। সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা ঠুনকো কার্যকরণকে উপলক্ষ করে নেয়া পদক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী ফল বয়ে আনে না। দলীয় সরকার শুধু নিজেদের মেয়াদকালে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ ও কার্যক্রম গ্রহণ করলে টেকসই উন্নতির সম্ভাবনা তো সীমিত হয়ে পড়বেই। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও দৃঢ়প্রত্যয় প্রয়োজন। সমস্যা গোচরে এলে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে সব সীমিত সম্পদ নিঃশেষ হতে দিলে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য পুঁজি ও প্রত্যয়ে ঘাটতি তো হবেই। তেল আনতে নুন ফুরায় যে সংসারে সেখানে সমৃদ্ধির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সব সমস্যা পরস্পরের মিত্র, একটার সঙ্গে আরেকটার যেন নাড়ির যোগাযোগ। আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে ব্যক্তি নিরাপত্তার, ব্যক্তি নিরাপত্তার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার, সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে আয়-উপার্জনের সব ধরনের কার্যক্রমের কার্যকরণগত সম্পর্ক রয়েছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চাই আয়-উপার্জনের সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ। শিক্ষা কর্মদক্ষতাকে, স্বাস্থ্যসেবা কর্মক্ষমতাকে কর্মদক্ষতা ও কর্মক্ষমতা উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে এটাই প্রত্যাশা। সর্বত্র  সেই পরিবেশের সহায়তা একান্ত অপরিহার্য, যেখানে সীমিত সম্পদ ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। একটাকে উপেক্ষা মানে যুগপৎভাবে অন্যান্য সমস্যাকে ছাড় দেয়া। সমস্যার উৎসে গিয়ে সমস্যা সমাধানে ব্রতী হতে হবে। এ কাজ কারো একার নয়, শুধু সরকারের তো নয়ই; এ কাজ  সবার। সব পর্যায়ে নেতৃত্ব প্রয়োজন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমাধানের জন্য, সমস্যা পরিপোষণের জন্য নয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা যে কোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য কি জনমত সৃষ্টিতে, কি আস্থা আনয়নে ও কি একাগ্রতা পোষণে। নেতিবাচক মনোভাবের রাসায়নিক ও কাঠামোগত  উদ্গিরণকে কোমলে-কঠোরে মোকাবিলা করতে হবে। যে কোনো সংস্কার বাস্তবায়ন কোনোমতেই সহজসাধ্য নয় বলেই সেখানে দৃঢ়চিত্ততা আবশ্যক। এখানে দ্বিধান্বিত হওয়া, দ্বিমত পোষণ কিংবা প্রথাসিদ্ধবাদী আমলা-বেনিয়া-মুৎসুদ্ধি মানসিকতার সঙ্গে আপস করার সুযোগ থাকতে নেই। রাজস্বনীতি ও নিয়মতান্ত্রিকতায় (ঋরংপধষ ঢ়ড়ষরপু) ব্যক্তি আয়করকে ৩০ শতাংশে উন্নীতকরণের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, দেশীয় শিল্প স্বার্থ ও সক্ষমতা সংরক্ষণ (ঢালাওভাবে মূসক প্রবর্তন বিতর্ক) ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি শ্রমঘন শিল্পব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা (কম দামের সিগারেটে অধিক শুল্কারোপ বিতর্ক) বাজেটে পুনঃনিরীক্ষণের অবকাশ রয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছে। বাজেটে স্বাস্ব্য খাতের নমিনাল বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রতিফলকে বোধহয় বাস্তবতার চশমায় দেখা দরকার।

লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতি বিশ্লেষক, সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

প্রকাশিত: অর্থনীতি প্রতিদিন, অনলাইন এডিশন