কাবেরী গায়েন

মিছিলের সব পথ মিলেছে আজ শাহবাগে। লাখো মানুষের ঢল সেখানে। শাহবাগের উত্তাল তারুণ্যের মহাসমাবেশ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নতুন ইশতেহার ঘোষিত হয়েছে: ‘আজ আমরা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’ ঘোষণা দিয়েছে বাংলার তারুণ্য দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের। ঘোষণা দিয়েছে এ দেশ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের এবং জামায়াতে ইসলামীসহ সব ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি নিষিদ্ধের। চার দিন ধরে তাঁরা বলছেন, ‘বুকের ভেতর জ্বলছে আগুন, সে আগুন ছড়িয়ে দাও।’ এই আগুন বাঙালি জাতি বুকের ভেতর চাপা দিয়ে রেখেছে ৪২ বছর। সেই বুকের আগুন তারুণ্যের ডাকে ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে। শাহবাগের মতোই সারা দেশের সব শহীদ মিনার আজ মুখরিত রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে। তাঁরা মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার বিচারের রায় মানেননি। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেছেন, কাদের মোল্লা তো বটেই, সব রাজাকারের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় না পাওয়া পর্যন্ত তাঁরা ঘরে ফিরে যাবেন না। এই দাবি তাঁরা জানিয়ে যাচ্ছেন চার দিন ধরে এবং আজকের মহাসমাবেশে বাঙালির রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’কে উচ্চারণ করে। এ রণধ্বনি দিয়েই ১৯৭১ সালে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছে, কাঁপন ধরিয়েছে পরাক্রমশালী পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর দুর্গে। অথচ ’৭৫-পরবর্তী ধর্মাশ্রয়ী সামরিক রাজনীতি বিতর্কিত করেছে বাঙালির রণধ্বনিকে। প্রতিস্থাপিত করেছে পাকিস্তানের আদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে। এই রণধ্বনিকে বিতর্কিত করতে পেরেছিল বলেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বুকে কাঙ্ক্ষিত কাঁপন ধরানো যায়নি পরবর্তী ৪০ বছর। যারা সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এই রাজনীতি করে গেছে, তাদের বুকে ফের কাঁপন ধরাতে এ দেশের তারুণ্য জাতিকে ফেরত দিয়েছে সেই রণধ্বনি। এই জাগ্রত তারুণ্যের কাছে তাই কৃতজ্ঞতা। কে আর রুধবে বাঙালির অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা; যখন তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ফিরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁর পরিচয়ের ঠিকানা, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। এ দুই মুক্তিযুদ্ধের প্রতীককে পুনরুদ্ধার করেছে যে তারুণ্য, পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।

আমি বেড়ে উঠেছি সামরিক শাসকদের ক্রূর সময়ে। মুক্তিযুদ্ধ শব্দটিই নিষিদ্ধ ছিল তখন, যেমন নিষিদ্ধ ছিল ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান। ৭ মার্চকে ভুলিয়ে দিতে রেসকোর্সের মাঠকে বানানো হয়েছিল শিশুপার্ক। আমি বড় হয়েছি হুর-এ-আরব, বাগদাদের চোর কিংবা আবেহায়াত নামের চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে। আসলে বাংলাদেশ ধারণাটিই নিষিদ্ধ করেছিল এ দেশের ক্রূর সামরিক সেনাপ্রধানদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। আমাদের কৈশোর আর তারুণ্য শুরুর কাল কেটেছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি যে করা যায়, শহীদজননী জাহানারা ইমাম সে কথা না তুললে হয়তো জানাই হতো না। সেই শহীদজননী জাহানারা ইমাম এ দেশের মাটিতে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি স্মরণ করছি সেই মহান মাকে। তিনি তাঁর অনাগত সন্তানদের ভেতর যুদ্ধাপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করার বীজমন্ত্র রোপণ করে গিয়েছিলেন। বিপ্লবের মন্ত্র আজ মূর্ত হয়েছে। হায় রাষ্ট্রদ্রোহ! প্রকৃত রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিচার যারা করবে, তারা প্রস্তুত হয়েছে। যে রাজনীতি আপসের, যে রাজনীতি ভয়ের, যে রাজনীতি বিভ্রান্তির, সেই রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে নতুন রাজনীতির অভিষেক মঞ্চকে স্বাগত জানাই। এই জাগরণ আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছেও এক বার্তা। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে কিংবা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে যাঁরা ক্ষমতায় যেতে মতলব আঁটেন, এই জাগরণ তাঁদের কাছে বার্তা পাঠায়, ‘সাধু সাবধান’। সেই বার্তা যদি তাঁরা কান পেতে না শোনেন, তারুণ্যের এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ তাঁদের বিরুদ্ধেও সমানই গর্জে উঠবে। কারণ, এই দেশের ভাবিকাল তাঁদের নির্দেশমতো চলবে, যেমন একদিন চলেছে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীনদের নির্দেশে। এবং আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ইতিহাস পাল্টানোর এই শুভমুহূর্তে রাজনৈতিক ব্যানারহীন নতুন রাজনীতির দেশকে অভিশাপমুক্ত করার ডাকটি জানাল ঠিক ঠিক মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনাকে ধারণ করেই। এর ভাষা নতুন, এর প্রতিজ্ঞা নির্ভীক এবং সেই আগুনের নির্মিত যে আগুন আমরা বুকের মধ্যে বহন করে এসেছি বহুকাল।

আর যাঁরা এই অসাধ্যটি সাধন করলেন আজ তাঁদের উদ্দেশে বলি, যাঁরা আপনারা হিমালয়কে জয় করেছেন, সেখানে উড়িয়েছেন বাংলাদেশের পতাকা প্রবল শীত-বিপদ-বাধাকে অগ্রাহ্য করে, যাঁরা এশিয়া কাপের ফাইনালে দেশ হেরে যাওয়ায় শিশুর মতো কেঁদেছেন—খেলোয়াড় হয়ে, খেলার দর্শক হয়ে, আপনারা যাঁরা পাটের জিনোম সিকুয়েন্স আবিষ্কার করেছেন, সারা পৃথিবীকে আপনারা বলে দিয়েছেন—আপনারাই বাংলাদেশ। আপনারা এগোচ্ছেন, এক চমৎকার গতিতে এই দেশ নিয়ে আপনারাই এগিয়ে চলেছেন। আপনাদের বানানো চলচ্চিত্র বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে নতুনভাবে পরিচয় করাবে। আপনাদের গবেষণা নোবেল বিজয়ী করবে আমাদের। জেনারেশনের ইন্টারনেট আপনাদের দরজায়। আপনারা চাইলেই ফেসবুকের আন্দোলন শাহবাগে নিয়ে যেতে পারেন, ছড়িয়ে দিতে পারেন সারা দেশে, সারা পৃথিবীতে। আপনাদের প্রতিবাদে নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশের রাজনীতি। আপনাদের কথা শুনতে বাধ্য হয় এ দেশের মানুষ। এটা আপনাদের দেশ। এটা আমাদের দেশ। এটা মানুষের দেশ। এটা কোনোভাবেই রাজাকার, আলবদর, আলশামস, যুদ্ধাপরাধীর দেশ নয়। আপনাদের আন্দোলন আজ সারা দেশকে বুঝিয়ে দিয়েছে, এ দেশে রাজাকার বুড়ো হবে, এ দেশে আলবদর বুড়ো হবে, বুড়ো হবে যুদ্ধাপরাধী। বুড়ো হবে দুর্নীতি। বুড়ো হবে স্বার্থান্বেষী রাজনীতি। এই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে যে আজ আপনারা উঠে দাঁড়ালেন, সোচ্চার হলেন, আপনাদের কাছেই সত্যিকার সূর্যোদয়ের দাবি জানিয়ে রাখছি। এ দেশে মুক্তিযুদ্ধকে কখনোই বুড়ো হতে দেবেন না। আপনাদের ডাকে শারীরিক বয়স বেড়েছে যে মুক্তিযোদ্ধার, তিনিও স্লোগানে, গানে, নাচে, মুষ্টিবদ্ধ হাতে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা-তারুণ্য প্রকাশ করে যাচ্ছেন শাহবাগ চত্বরে। আপনারা জেগে থাকলে, এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ কখনোই বুড়ো হবে না।

মানুষের বাংলাদেশ জাগছে। ‘আমাকেও সাথে নিও, ও ভাই, ও বোন! হে বন্ধু!’ জয় বাংলা।

ড. কাবেরী গায়েন: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রথম আলো: তারিখ: ১০-০২-২০১৩