ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসেবে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা এক লাখের বেশি। কিন্তু যারা আক্রান্ত তাদের অর্ধেকই জানেন না যে তাদের ডায়াবেটিস রয়েছে।
চিকিৎসকেরা বলছেন বাংলাদেশে বহু মানুষ আছেন যারা রোগটি বড় কোন সমস্যা তৈরি করলে তখন সেটির চিকিৎসা করাতে গিয়ে তারা ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানতে পারেন।যদিও ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় অনেক অগ্রসর হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞান।


প্রতিদিন পেটে ইনসুলিন ইনজেকশন

ডায়াবেটিসে একবার আক্রান্ত হলে তা চিকিৎসায় পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না। ডায়াবেটিস এমন একটি শারীরিক অবস্থা যা একবার ধরা পড়লে সারা জীবনের জন্যে বয়ে বেড়াতে হয়।
প্রতিদিন একবার পেটে ইনসুলিন ইনজেকশন, জীবনযাপনে পরিবর্তন ও নানারকম বিধিনিষেধ মেনে চলা স্বত্বেও রোগটি সারা জীবন ধরে সাথী হয়ে থাকবে এই বিষয়টি খুব পীড়া দেয়, বলছিলেন একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা শামীম আহসান খান।“আমার তখন ৩৮ বছর বয়স হবে। কোন ধরনের অসুখ বা শারীরিক সমস্যা ছিল না। হঠাৎ করে শুকিয়ে যেতে শুরু করলাম। কিন্তু খুব খিদে পেত, সারাক্ষণ গলা শুকিয়ে যেত। খুব একটা পাত্তা দেইনি। সহকর্মীদের একজন বলার পর পাড়ার দোকানে সুগার মেপে দেখি গ্লুকোজ লেভেল ২৭। ওই জানলাম যে আমার ডায়াবেটিস আছে।”মি. খান তারপরও সাত আট বছর নিজের খুব একটা যত্ন নেননি। তবে গত কয়েক বছর হল সম্বিত ফিরে পেয়েছেন।“আমি এখন নিয়মিত সবকিছু মেনে চলি। ঔষধ খাই। প্রতিদিন নিজেই একবার করে পেটে ইনসুলিন ইনজেকশন পুশ করি। ডায়াবেটিসের সাথে আমাকে বাকি জীবন বসবাস করতে হবে এটা আমি মানসিকভাবে গ্রহণ করে নিয়েছি।“কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে একটা ইনজেকশন পেটে পুশ করতে হয় এটা একটা বোঝা। ভালো লাগে না। যদি অন্য কোন বিকল্প থাকতো তাহলে ওটাকে আমি অবশ্যই বাদ দিতাম।”


যেভাবে বদলে যাচ্ছে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা

শামীম আহসান খানের ইচ্ছেটা হয়ত অদূর ভবিষ্যতে বাস্তব রূপ নেবে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জীবন সহজ করতে অনেকদূর এগিয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞান।শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের মেডিসিন, হরমোন এবং ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ তানিয়া তোফায়েল বলছেন, “ডায়াবেটিসের চিকিৎসা অনেক উন্নত হয়েছে। যেমনধরুন আগে সুইদিয়ে ইনজেকশন দিতে হতো। সেই সুই অনেক মোটা ও কষ্টদায়ক ছিল। এখন পেনের মতো ডিভাইস হাতের কাছেই পাওয়া যায়।“আবার আগে ইনসুলিন নিয়ে আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। এখন এমন ইনসুলিন পাওয়া যায় যা শরীরে দ্রুত কাজ করে। তাই সাথে সাথেই খাবার খাওয়া যায়। তারপর যেমন প্রতিদিন সুইয়ের গুঁতো খেতে কার ভালো লাগে। এখন কিছু ইনসুলিন সপ্তাহে একদিন দিলেই হয়।”

আরও পড়ুন

খাদ্যে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় ক্ষতিকর ধাতব


তিনি আরও বলছেন, ডায়াবেটিসের সাথে শরীরের স্থূলতার অনেক বড় সম্পর্ক রয়েছে। একজন ব্যক্তির ওজন যত বেশি, তার ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও তত বেশি। আর তাতে এক পর্যায়ে ইনসুলিনের প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে যায়।এখন কিছু ইনজেকশন আছে যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে আবার একই সাথে ওজন কমায়।“এগুলো খুবই প্রমিসিং ঔষধ। যদিও এগুলোর খরচ এখনো বেশি। আর পশ্চিমা বিশ্বে মাসে একবার ইনসুলিন নিতে হয় তারা এমন ব্যবস্থায় চলে এসেছে। যদিও বাংলাদেশে এটা এখনো পাওয়া যায় না।“আর মুখে খাওয়ার ইনসুলিন বড়ি বা ক্যাপসুল সেটা হয়ত খুব শীঘ্রই বাজারে বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যাবে। এখনো বাজারে আসেনি”, বলছিলেন তানিয়া তোফায়েল।


তবুও জামের বিচি আর মেথির রসে আস্থা

বাংলাদেশে বহু মানুষ আছেন যারা ডায়াবেটিসকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। একবার ধরা পড়লেও চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। গেলেও পরামর্শ মেনে চলেন না।
অথবা ভেষজ চিকিৎসায় আস্থা রাখাটাই পছন্দ করেন। তেমন একজন খুলনার নিরালা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা শাহিন আরা হক।চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ঔষধ খাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু তারা সাথে চলছে আরও অনেক কিছু যার কার্যকারিতা প্রমাণিত নয়।“আমি মেথি পানিতে ভিজিয়ে রেখে সেই পানিটা খাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে চিরতার পানি খাই। জামের বিচির গুড়ো রাত্রে ভিজিয়ে রেখে সকালে পানিটা খাই। সকালে যে হাঁটতে বের হই, আমাদের গ্রুপে আমার যেসব বান্ধবীরা আছে তারা সবাই বলেছে এগুলোর খুব উপকার আছে। তারা খেয়ে অনেকে ফল পেয়েছে। আমার মনে হয় কোন কিছু বিশ্বাস করে খেলে ফল পাওয়া যায়, এই আস্থাটা আমার আছে।”তবে চিকিৎসক তাকে বলেছেন একদম নিয়মিত নয়, এগুলো মাঝে মাঝে খেতে।


তানিয়া তোফায়েল বলছেন, “বাংলাদেশে অনেকেই রক্তে গ্লুকোজ কমাতে করল্লার রস খান। ইউটিউবে নানা ভিডিও বা গুগল করে নিজেরা নিজেদের উপর এক্সপেরিমেন্ট চালায়। রক্তে গ্লুকোজ কমে গেলে অনেকে মনে করে বোধ হয় ডায়াবেটিস ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু এই রোগ পুরোপুরি সারানো যায় না। তবে এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়।”


গবেষণায় যত অগ্রগতি

এবছরের মে মাসে ওরামেড ফার্মাসিউটিক্যালস নামের একটি কোম্পানি টাইপ-টু ডায়াবেটিসের জন্য প্রথম মুখে খাওয়ার ইনসুলিন ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপ শুরু করেছে।ছয়মাস ধরে সাতশ জন ডায়াবেটিস রোগীর উপর এর ট্রায়াল চলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওরালিস প্রকল্পের সহায়তায় এই ঔষধটি ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় নতুন যুগের উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
২০১৮ সালে ব্রিটেনের কার্ডিফ অ্যান্ড ভেলস ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক জানান তারা ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরে ইনসুলিন হরমোন উৎপাদন করার সেল পুনরায় তৈরি করতে পারবে এরকম একটি ঔষধ নিয়ে কাজ করছেন।তারাও মানবদেহে ট্রায়ালের কথা জানিয়েছেন। ইনসুলিন হরমোন তৈরি হয় প্যানক্রিয়াসে।আর একটি অগ্রগতি হচ্ছে কৃত্রিম প্যানক্রিয়াস। মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এটি তৈরির অনুমোদন দিয়েছে।


সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে ডিভাইসটির একটি অংশ ডায়াবেটিক রোগীদের শরীরের ত্বকের নিচে লাগানো থাকে। এতে সেন্সর রয়েছে যা শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা বুঝতে পারে এবং সংকেত পাঠাতে পারে।মোবাইল ফোনে সংকেত পাঠানোর ব্যবস্থাও এখন তৈরি হয়েছে। কতটুকু ইনসুলিন দরকার হবে সেই সংকেত চলে যায় যন্ত্রটির আর একটি অংশ ‘ইনসুলিন পাম্পে’। এই পাম্প সঠিক মাত্রার ইনসুলিন ত্বকের নিচে ‘টিস্যুতে’ পৌঁছে দেয়।
শাহনাজ পারভীন

সূত্র-বিবিসি বাংলা


আরও পড়ুন

৮০০ কোটির বিশ্বে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা

অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় হাতিয়ার হলো শিক্ষা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের ‘পাঠে কেন মন বসে না