বণিক বার্তা- মার্চ ২৬, ২০২০

মহামারীর বিরুদ্ধে লড়ছে বিশ্ববাসী। এরই মধ্যে চীন ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস। দেশে দেশে কভিক-১৯ রোগটি কেড়ে নিচ্ছে লাখো মানুষের জীবন। কার্যত স্তব্ধ হয়ে গেছে বিশ্বের বড় একটি অংশ। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ২৫০ কোটির বেশি মানুষ এ মুহূর্তে লকডাউনের আওতায় ঘরবন্দি জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। সংকট দেখা দিয়েছে খাবারসহ নিত্যপণ্যের। এ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক পণ্যবাজার গভীর সংকটে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মহামারীর সময় স্বাভাবিকভাবেই খাবারের সংকট তৈরি হয়। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ এক, দুই কিংবা তিন সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছে। ঘরে ঢোকার আগে মানুষ বাড়তি খাবার কিনেছেন। এর জের ধরে বিশ্বজুড়ে হঠাত্ করেই খাবারের চাহিদা বেড়েছে। অনেক দেশে চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে।

বিদ্যমান সংকটের নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিভিন্ন দেশ শস্য ও খাদ্যপণ্য রফতানি সাময়িক বন্ধ করে দেয়ায়। কাজাখস্তান বিশ্বের অন্যতম আটা-ময়দা রফতারিকারক। ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে দেশটি আটা, ময়দা, চিনি, সবজি রফতানি আপাতত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। ইউরোপের দেশ সার্বিয়া সূর্যমুখী তেলসহ কয়েকটি পণ্যের রফতানি স্থগিত করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চাল রফতানিতে ক্লিয়ারেন্স দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে ভিয়েতনামের রাজস্ব বিভাগ।

সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ শুনিয়েছে রাশিয়া। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ১০ দিনের জন্য বিশ্বজুড়ে শস্য রফতানি বন্ধ রাখতে রুশ রফতানিকারকদের নির্দেশ দিয়েছে ক্রেমলিন। রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শস্য রফতানিকারক দেশ। বিশেষত গম, ভুট্টা, যব, সয়াবিন তেলের রফতানি বাজারে দেশটির ভূমিকা অগ্রগণ্য। এ কারণে রাশিয়া থেকে রফতানি সাময়িক বন্ধ হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিপণ্যের দামে বড় ধরনের উত্থান-পতন দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এরই মধ্যে শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) গমের দাম ৬ শতাংশ বেড়েছে। আমিষপণ্য, চিনি, ভোজ্যতেলের দামও বাড়তির দিকে। সরবরাহ সংকটের কারণে চলতি মাসে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক মূল্যসূচক ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির পর সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিভাগ (এফএও)। সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ মেক্সিমো টোরেরো বলেন, এটা খুবই অনিশ্চিত একটি সময়। এ সংকট থেকে দ্রুত বেরোনোর জন্য সমন্বিত নীতির আওতায় কার্যকর বৈশ্বিক উদ্যোগ নিতে হবে।

ব্রিটিশ থিংকট্যাংক চাথাম হাউজের গবেষণা পরিচালক টিম বেন্টন বলেন, মহামারী ও লকডাউনের সময় সব দেশই নিজেদের নাগরিকদের অন্ন সংস্থানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ কারণে রফতানিতে লাগাম টেনেছে অনেকে। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে পণ্যবাজারের টালমাটাল অবস্থা আরো জোরদার হতে পারে।

জ্বালানি তেলের বাজারে সংকট আরো গভীর। একদিকে বৈশ্বিক মহামারীতে চাহিদায় পতন, অন্যদিকে সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যকার মূল্যযুদ্ধ এ দুইয়ের কারণে জ্বালানি তেলের বাজারে রেকর্ড দরপতন ঘটেছে। ফেব্রুয়ারির শুরুতে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড এবং ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম ৫০ ডলারের উপরে ছিল। বর্তমানে তা ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২০ সালজুড়ে জ্বালানি তেলের বাজারে মন্দা ভাব বজায় থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।

মন্দার মুখে রয়েছে ধাতুর বাজারও। তামা, অ্যালুমিনিয়াম, দস্তা, নিকেলসহ কয়েকটি ব্যবহারিক ধাতুর বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে। ইস্পাতের দামেও টালমাটাল অবস্থা বজায় রয়েছে। উত্থান-পতনে রয়েছে স্বর্ণ ও রুপার বাজার। চলতি মাসের শুরুতে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৭০০ ডলারে উঠেছিল। তবে এখন মূল্যবান ধাতুটির দাম আউন্সপ্রতি ১ হাজার ৫০০ ডলারের নিচে রয়েছে। অনিশ্চয়তা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তুলনামূলক নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণ কিনছেন অনেকেই।

বাজার বিশ্লেষক অ্যান বার্গ বলেন, বৈশ্বিক মহামারী অনেকটাই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এ সময় খাদ্য ও কৃষিপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে অভ্যন্তরীণ মজুদ প্রবণতা কমিয়ে আনা, রেশন ব্যবস্থা চালু এবং বাজার মনিটরিং জোরদার করা কার্যকর উপায় হতে পারে। আর জ্বালানি তেলের বাজার পরিস্থিতি ফেরাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতামূলক সম্পর্কের বিকল্প নেই।